কখন শেয়ার বিক্রি করবেন? নতুন বিনিয়োগকারীদের জানা আবশ্যক।

4.2/5 - (4 জন রেটিং করেছেন)

শেয়ার কেনার সময় যারা সবথেকে শর্টকাট রাস্তাটা ধরে তারা বন্ধু-বান্ধব, টেলিগ্রাম চ্যানেল, সংবাদ মাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি বিবিধ জায়গায় যা টিপ ফিপ পায় তাই শুনেই ফটাফট ডিম্যাট খোলে আর শেয়ার তোলে। আর অন্যদিকে যারা একটু সাবধানী হয় তারা কেনার আগে একটা ভালো কোম্পানি বাছাইয়ের লজিক গুলো বোঝার চেষ্টা করে, একটা কোম্পানি নজরে এলে সেই কোম্পানির কাজকর্ম ও ভিতরের গল্পগুলো জেনে নেয়, তারপর কেন অমুক কোম্পানিতে টাকা ঢালবে তার এক বা একাধিক কারণ খুঁজতে উদ্যত হয়। অতঃপর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা করার পর বাছাই করা কিছু মাস্টারপিস শেয়ার কিনে থাকে।

যাইহোক, এখন শর্টকাটে হোক কিংবা ঘোরপথে, অমুক শেয়ার হোক কিংবা তমুক, কিনে ফেলে পোর্টফোলিও তো ভরিয়ে ফেলা হলো, কিন্তু তারপর? কেনার পরে দামের যাই পরিবর্তন হোক সেটা কিন্তু আপাতত পোর্টফোলিওতে কাগজ-কলমের হিসেবেই থাকে। দাম বাড়ার পর লাভ বাস্তবায়িত করতে হলে কিংবা দাম কমার পর লসটা কম থাকতেই হজম করে নিতে হলে শেয়ার বিক্রি করে দিতে হয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত এটা করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কিন্তু দাম বাড়ার ক্ষেত্রে লাভটাও হাতে আসেনা বা কমার ক্ষেত্রে লসের আঁচটাও গায়ে লাগেনা। তাই বাছাই করা শেয়ার ডিম্যাটে তোলার পর ফাইনাল স্টেপ হচ্ছে লাভ ঘরে তোলা বা প্রফিট বুক করা অথবা লস আরও বড় হওয়া থেকে পোর্টফোলিওকে বাঁচানো।

কিন্তু এটা করার জন্য শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার আদর্শ সময় কখন? কতখানি লাভ বা ক্ষতি হলে কিংবা কেমন পরিস্থিতিতে শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া উচিৎ?

সেটাই আলোচনা করব আজ এই নিবন্ধে…

সূচীপত্র দেখান

‘কনফিউশন হি কনফিউশন হ্যায় সলিউশন কুছ পাতা নেহি!’

এই শেয়ার বেচার বিষয়টা কিন্তু হেব্বি বিভ্রান্তিকর। ধরুন আপনার পোর্টফোলিওর একটা শেয়ারের দাম বেড়ে ডবল হয়ে গেছে। আপনি ভাবলেন, ‘অনেকটা বেড়ে গেছে, এবার নাহয় এটাকে বেচে দিই।’ কারণ আপনার আশঙ্কা এর পরেও লোভ করলে যদি আবার দামটা কমে যায়! কিন্তু যেই না বেচে দিলেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই সেটা আড়াই গুণ হয়ে গেলো। আরো কিছুদিন যেতে না যেতেই ৩ গুন। পরিস্থিতি দেখে আপনি শুধু আফসোস করতে থাকলেন, ‘ইশ! যদি আর একটু অপেক্ষা করে যেতাম…।’

আবার অন্যদিকে, ধরুন আর একটা শেয়ারের দাম কেনার পরে শুধু কমতেই থাকছে আর কমতেই থাকছে। যখন ১০% কমলো তখন তো কোনো গুরুত্বই দিলেন না। তারপর সেটা কমতে কমতে যখন -৩০% হলো তখন ভাবলেন আরো কিছু কোয়ান্টিটি অ্যাড করে গড় দামটা একটু কমিয়ে নেওয়া যাক। এরপর লসটা আরও বেড়ে আপনার ইনভেস্টমেন্টের ভ্যালু হাফ হয়ে গেলো। তখনও আপনি কোনও পদক্ষেপ নিলেন না, বেড়ে যাওয়ার আশায়। এরপর যখন পোর্টফোলিওতে নেগেটিভ ৮০% দেখাতে থাকলো তখন ভাবলেন ভ্যালু যখন এতটাই নেমে গেছে এখন আর এটাকে বেচে বা এটার কথা ভেবে কাজ নেই। যা হয় হবে, যখন হয় হবে, ওটা ওভাবেই পড়ে থাক।

শেয়ার কেনাবেচার ক্ষেত্রে এই রকমটা আমাদের সঙ্গে অনেক সময়ই হয়ে থাকে। আমাদের পোর্টফোলিওটাকে যদি একটা বাগানের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে ব্যাপারটা এইরকম হয়ে গেলো যে, ঐ বাগানে যে গাছটা ভালো ফল দেয় আমরা অনেক সময়ই সেটাকে আগে কেটে ফেলি কারণ অনেকটা ফল পাওয়া হয়ে গেছে এই ভেবে। আর যে গাছটায় একটাও ফল হয় না, কোনো একদিন ফল পাওয়ার আশায় সেই গাছটাকে রেখে দিই তো বটেই, উপরন্তু অনেক সময় তাতে আরো সার, জল দিই বা তার ওপরে আরো খরচ করে থাকি (মানে আরও কোয়ান্টিটি অ্যাড করি)… কিন্তু আপনি নিজেই ভেবে দেখুন, এই রকমটা করা কি যুক্তিযুক্ত?

আরও পড়ুনঃ  শর্ট সেলিং-এর সাতকাহন। যখন শেয়ারের দাম কমলেও লাভ হয়…!

আলাদা আলাদা বিনিয়োগকারীর জন্য পরিস্থিতিটা উপরের দুটো উদাহরণের থেকে কখনো কখনো কিছুটা আলাদা হলেও ‘কখন বেচব’ এটা সব সময়ই একটা সমস্যা। এই বাজারের অনেক পোড় খাওয়া বিনিয়োগকারীদেরও অনেক সময়েই এই আফসোস করতে শোনা যায় যে, অমুক শেয়ার, তমুক শেয়ার ইত্যাদি যদি তাড়াতাড়ি না বেচে রেখে দিতেন তাহলে কোটি কোটি টাকা কামাতে পারতেন…।

এই সমস্যাটা যাতে আপনাকেও ফেস করতে না হয় কিংবা অন্তত এটার তীব্রতা যাতে কম হয় তার জন্য বেচার সঠিক মুহূর্তের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কেনার সময়ই কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরী… 

শেয়ার কেনার আগে করনীয়

যদি কেনার সময়েই কিছু গণ্ডগোল হয়ে যায় বা ভুল করে গণ্ডগোলের শেয়ার কেনা হয়ে যায় তাহলে বেচার সঠিক সময় তখনই, যে মুহূর্তে আপনি সেটা বুঝতে পারবেন। কারণ গন্ডগোলের শেয়ার বেচার কথা বাদ দিন কেনাটাই ভুল ছিল। তাই যেকোনো সময়ে কেনার অন্তিম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজেকে একটা প্রশ্ন করুন…

আপনি কি আপনার সমস্ত সম্পত্তি উক্ত কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত?

সমস্তরকম রিসার্চ ও অ্যানালিসিস করার পর যেকোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার আগে এই প্রশ্নটা করলে যদি আপনার উত্তর হ্যাঁ হয় তবেই সেই কোম্পানির শেয়ার কেনার কথা ভাবুন। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর তখনই হ্যাঁ হতে পারে যখন একটা কোম্পানির ব্যাপারে সবরকম ধারণাগুলো কাঁচের মত পরিষ্কার হয়, তাদের ব্যবসার ধরণ এবং প্রতিযোগিতার বিষয়ে স্পষ্ট আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকে, প্রোমোটার ও ম্যানেজমেন্টের উপর পুরো ভরসা থাকে, তাদের ইতিহাস জানা থাকে এবং সেক্টর তথা কোম্পানির ভবিষ্যতের সম্ভাবনা সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে।

এই প্রশ্নের উত্তরে যদি কোনোরকম দ্বিধার অবকাশ থাকে সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। আর যতক্ষণ না পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর একটা বড় ‘হ্যাঁ’ হয় ততক্ষন রিসার্চ বন্ধ করা বা বিনিয়োগের উপযোগী সঠিক শেয়ারের খোঁজ থামানো ঠিক নয়।

কেনার সময় করনীয়

উপরের প্রশ্নটার উত্তর হ্যাঁ হয়ে গেলে বা বিনিয়োগযোগ্য নিখুঁত কোম্পানি পেয়ে গেলে, শেয়ার কেনার সময়েই সেটা বেছে নেওয়ার পেছনে প্রধান কারণটা বা কারণ গুলো কী কী সেগুলো আপনাকে নোট করে রাখতে হবে। কারণ ভবিষ্যতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ওটা বেচে দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ওই লিখিত কারণগুলো আপনার কাজে আসবে।

কখন শেয়ার বিক্রি করে দেবেন?

দারুন শেয়ার বাছাই করে কিনে নেওয়ার পর এমনিতে লক্ষ্য হওয়া উচিত অনন্তকালের জন্য সেটা ধরে রাখার। কিংবদন্তি ইনভেস্টার ওয়ারেন্ট বাফেট বাবুও সেই কথাই বলেন। কিন্তু শেয়ার কেনা মানে আসলে আমরা তো চাই আমাদের বিনিয়োগ করা টাকা বাড়িয়ে সেই বর্ধিত টাকায় জীবনের শখ, ইচ্ছা বা প্রয়োজন গুলো পূরণ করতে। তাছাড়া আমরা আমাদের ব্যক্তিগত এবং তার সাথে সমাজ, পৃথিবী এবং কোম্পানির যে পরিস্থিতির উপর নজর রেখে শেয়ারটা কেনার সিদ্ধান্ত নিই সেটা ভবিষ্যতে একই রকম নাও থাকতে পারে। আর কেনার সময় যত সঠিক ও ভালো শেয়ারই বাছা হোকনা কেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটার দাম প্রত্যাশা মতো না বাড়তে পারে বা কমেও যেতে পারে। তাই সবদিক বিচার করে তখনই শেয়ার বেচে দেওয়া উচিৎ যখন,

#১ যে কারণে কিনেছিলেন সেই কারণটাই আর থাকেনা

একটু আগেই কেনার সময় কেনার কারণটা নোট করে রাখতে বলেছিলাম। প্রধান যে কারণে একটা শেয়ার কিনেছিলেন সেই কারণটাই যদি আর না থাকে তাহলে সেটা বেচে দেওয়াই মঙ্গল।

যেমন ধরুন একটা ভালো কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সাথে সরকারের বিভিন্ন কনস্ট্রাকশনের কাজ করার জন্য ১০ বছরের একটা চুক্তি হলো। আপনি এটা খুব ভালো একটা সুযোগ বুঝে ওই কোম্পানিটার শেয়ার কিনে নিলেন। কিন্তু পরের বছর আইনি জটিলতায় সেই চুক্তি বাতিল হয়ে গেল। এই অবস্থায় যেহেতু আপনি ওই চুক্তির উপর ভিত্তি করেই বিনিয়োগটা করেছিলেন এবং যখন ওই চুক্তিরই অস্তিত্ব থাকলো না তখন ওটা বেচে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

#২ নিজের লক্ষ্য বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়ে যায়

নিজের লক্ষ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। এবং আলাদা আলাদা বিনিয়োগকারীর জন্য এগুলো আলাদা হয়। এক লক্ষ্য বা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কেনার পর ভবিষ্যতে যদি এগুলোর কোনো পরিবর্তন হয় সেই অনুযায়ী কিছু কিছু শেয়ার বেচে দেওয়া যেতে পারে।

যেমন, ধরুন লং টার্মের বিচারে কিছুটা বেশি রিটার্নের আশায় একটু ঝুঁকিপূর্ণ কোনো শেয়ার কিনেছিলেন। কিন্তু কয়েকবছর পরে আপনার মনে হয়েছে কম সময়ের মধ্যে আপনার কিছু টাকার প্রয়োজন হতে পারে। তাই ঝুঁকি কমিয়ে কম সময়ে ঠিকঠাক রিটার্ন পাওয়ার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারগুলোকে বিক্রি করে তার জায়গায় কম ঝুঁকিপূর্ণ কিছু কেনা যেতে পারে বা ক্যাশটা অন্য কোনো জায়গায় রাখা যেতে পারে।

আবার ধরুন টোব্যাকো সেক্টর সম্পর্কে আপনি পাঁচ বছর আগে খুবই আশাবাদী ছিলেন, কিন্তু আজ নীতিগত ও অন্যান্য কারণে ওই সেক্টর সম্পর্কে একদমই কম্ফোর্টেবল নন। তাই এক্ষেত্রে ওই সেক্টরের শেয়ার বেচে দেওয়াই আপনার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হবে।

আরও পড়ুনঃ  কিভাবে ইন্ট্রা ডে ট্রেডিং এর জন্য স্টক নির্বাচন করবেন? নতুনদের জন্য

#৩ কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল্‌স-এ কোনও বড় কোনও সমস্যা তৈরি হয়

বিনিয়োগের জন্য শেয়ার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সব থেকে আগে যেটা দেখা হয় সেটা হচ্ছে কোম্পানিটা কেমন বা সেটার ফান্ডামেন্টালস কতটা শক্তিশালী। যদি সেই বিষয়েই কোনো বড়োসড়ো সমস্যা দেখা যায় এবং সেটা কম সময়ের মধ্যে ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তবে সেক্ষেত্রে বেচে দেওয়াই ভালো।

ফান্ডামেন্টাল্‌স-এর সমস্যা অনেক রকম হতে পারে। যেমন ধরুন সেল বা আয় কমে যাওয়া, ক্যাশ ফ্লো কমে যাওয়া, প্রমোটারের প্লেজ করা, ঋণ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। কোম্পানির স্টেটমেন্টে এ ধরনের সমস্যা চোখে পড়লে খোঁজখবর নিয়ে দেখতে হবে এর কারণটা কী। তারপরের বিচার্য বিষয় হবে সমস্যাটা সাময়িক নাকি স্থায়ী। যদি স্থায়ী হয় তাহলে বেচে দিতে হবে।

এছাড়া কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের লোকের আচরণে বা কথাবার্তায় কিছু অসঙ্গতি দেখলে কিংবা অনৈতিক কোনো কিছুর আঁচ পেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনার পোর্টফোলিও থেকে ওই কোম্পানিটাকে বাদ দেবেন, আপনার পোর্টফোলিওর জন্য ততই মঙ্গলময় হবে।

#৪ কোম্পানির ইন্ডাস্ট্রি বা সেক্টর কিছু প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে

আপনার পোর্টফোলিওর কোনো কোম্পানি যে ইন্ডাস্ট্রি বা সেক্টরের অন্তর্গত সেই ইন্ডাস্ট্রিতে যদি এমন কোন বদল আসে যার জন্য ঐ সেক্টরের সমস্ত কোম্পানির বিজনেস মডেল, আয় ইত্যাদি সবকিছুতে বিশাল নেগেটিভ পরিবর্তন চলে আসে তবে সেই শেয়ার বেচে দেওয়াই ভালো।

যেমন ধরুন সাধারণ ফিল্ম-ওয়ালা ক্যামেরার পরে যখন সস্তার ডিজিটাল ক্যামেরার আবির্ভাব ঘটলো তখন ঐ ডিজিটাল ক্যামেরার চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ছিল। তো সে সময় আপনি যদি ক্যামেরার কোনো বড় কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতেন সেটা ভুল হত না। কিন্তু তারপরে বাজারে স্মার্টফোন এলো এবং সাথে নিয়ে এলো ইন-বিল্ট ডিজিটাল ক্যামেরা এবং প্রতি বছর ওই ক্যামেরার গুণমান দারুণ থেকে দারুণতর হতে থাকলো। আর এর প্রভাব সরাসরি পড়লো ডিজিটাল ক্যামেরার বাজারে। তো ঐ সময়ে ক্যামেরার কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনা থাকলে সেটা বেচে দেওয়াই হত বুদ্ধিমানের কাজ।

এই সমস্যাটা অনেক সময় আপনার পছন্দের কোম্পানি বাদে ওই সেক্টরের অন্য দুর্বল কোম্পানির অ্যানুয়াল রিপোর্টে প্রথম প্রকাশ্যে আসে। তাই এ ব্যাপারে নজরদারির জন্য আপনার বেছে নেওয়া কোম্পানি যে সেক্টরের অন্তর্গত সেই সেক্টরের অন্য কোম্পানির ব্যাপারেও একটু খোঁজখবর রাখা লাভজনক হতে পারে।

#৫ আরও ভালো অন্য কোম্পানি পাওয়া যায়

আমাদের মূলধন সীমিত। আমরা যখন একটা শেয়ার কেনার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করি তখন সেই টাকা দিয়ে অন্য আরেকটা শেয়ার কেনার সুযোগ হাত থেকে বেরিয়ে যায়।

কিন্তু বড় বিনিয়োগকারী হতে হলে কখনোই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করা চলবে না। ধরে নিই পোর্টফোলিওতে ইতিমধ্যে একটা দারুণ কোম্পানি আছে। কিন্তু রিসার্চ করতে গিয়ে তার থেকেও ভালো সম্ভাবনাযুক্ত একটা কোম্পানির শেয়ার পাওয়া গেল। এক্ষেত্রে যদিও পুরানোটায় কোনো খুঁত নেই, তবুও ওটাকে বেচে দিয়ে নতুনটা কেনাই বেশি যুক্তিযুক্ত হবে।

#৬ একটা শেয়ার পোর্টফোলিওর অনেকটা হয়ে যায় বা পোর্টফোলিও রিব্যালেন্সিং করতে হয় 

শেয়ারবাজারে ঝুঁকি সব সময়েই থাকে। আর ঐ ঝুঁকি কমানোর একটা উপায় হচ্ছে ডাইভারসিফিকেশন। আপনার পোর্টফোলিওতে কোনো একটা শেয়ার বেড়ে বেড়ে পোর্টফোলিওর সিংহভাগ হয়ে গেলে সেটা যত ভালোই হোক না কেন পোর্টফোলিওর উপর ঝুঁকি কিন্তু বেড়ে যায়। কারণ তখন ঐ একটা শেয়ারের উপর কোনো কারণে কোনো প্রভাব পড়লে তার আঁচ গোটা পোর্টফোলিওতে অনেকখানি লাগে। তাছাড়া এই বাজার সাইক্লিকাল হয়। কখনো এই ধরনের শেয়ার গুলো বাড়ে তো কখনো ওই ধরনের গুলো।

এমতাবস্থায় সমগ্র পোর্টফোলিওর হেলথ এর জন্য ওই সিংহভাগ অধিকার করা শেয়ারের কিছু কোয়ান্টিটি কমিয়ে এবং তার বদলে অন্য শেয়ারের কিছু কোয়ান্টিটি বাড়িয়ে রিব্যালেন্সিং করে নেওয়া উচিৎ কাজ হবে।

#৭ লং টার্ম লুজার কেনা হয়ে যায় 

ধরুন আপনি কয়েক বছর আগে সব দিক বিচার করে খুবই ভালো একটা কোম্পানি বেছে নিয়েছিলেন।  আপনার গণনা অনুযায়ী কোম্পানিটা খুবই ভালো এবং সম্ভাবনাময় ছিল। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে শেয়ারের দামে সেই সম্ভাবনার কিছুই প্রকাশ পায়নি। বরং উল্টোটাই হয়েছে মানে দাম ক্রমাগত কমেছে।

কখনো কখনো সবকিছু ঠিক আছে মনে হলেও শেয়ারের দাম এমন কিছু কারণে ওঠা পড়া হয়, যেটা ধর্তব্যের বাইরে থাকে। তাই এ ধরনের পরিস্থিতিতে একটা শেয়ারকে লম্বা সময় ধরে সুযোগ দেওয়ার পরেও যদি কোনো আশার আলো না দেখা যায় তবে সেক্ষেত্রে আরও বেশি লস ঠেকাতে সেটাকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তই সঠিক হবে। 

ট্যাক্স লস হারভেস্টিং

লসে বিক্রি করার সময় সেটার মাধ্যমে ট্যাক্স বাঁচিয়ে অন্যদিক দিয়ে কিছু টাকা বাঁচিয়ে নেওয়া যায়। ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্সের নিয়মে শেয়ার বিক্রি করার সময় যে লাভ হয় সেটার উপর ট্যাক্স দিতে হয়। তো এক্ষেত্রে বিক্রির লস টা ক্যাপিটাল গেইন থেকে বাদ পড়ার ফলে কম ট্যাক্স দিতে হয়। ফলে পরোক্ষভাবে কিছু টাকা বেঁচে যায়। এটাকে ট্যাক্স লস হারভেস্টিং বলে।

আরও পড়ুনঃ  শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের বা শেয়ার কেনার 15 টা ঝুঁকি

#৮ যখন টাকার দরকার পড়ে

এমনিতে বিনিয়োগের নিয়ম হচ্ছে যে টাকাটা আগামী কয়েক বছরে আপনার প্রয়োজন পড়বে না সেই টাকায় বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু কয়েক বছর পর হলেও টাকার প্রয়োজন তো কখনো না কখনো আপনার পড়বেই। তাছাড়া যদি প্রয়োজনে ব্যবহার না করা হয় তাহলে আর সেই বিনিয়োগের অর্থটাই বা কি রইল!

তাই একটা সময় পরে ব্যক্তিগত যেকোনো কারণে টাকার প্রয়োজন পড়লে যখন প্রয়োজন পড়বে সেটাই শেয়ার বেচার সঠিক সময়।

কখন শেয়ার বিক্রি করবেন না?

কখন বিক্রি করতে হয়ে সেটা জানার পাশাপাশি কখন বিক্রি করা উচিৎ নয় সেটাও জেনে রাখা উচিৎ…

শেয়ারের দাম বাড়লে বা কমলে

কেবলমাত্র দাম বেড়ে গেছে বা ২-৩ গুন হয়ে গেছে বলে বেচে দেওয়াটা কোনো ভালো কাজ নয়। এই বাজার থেকে পর্বতপ্রমাণ সম্পদ বানাতে গেলে ২-৩ গুণে থেমে গেলে চলবে না, ২০-৩০ গুন কিংবা ৫০-১০০ গুনের লক্ষমাত্রা রাখতে হবে। আর সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন যৎসামান্য লাভে বেচে না দেওয়া হবে এবং ধৈর্য ধরা হবে। 

একইভাবে দাম কমে গেছে, শুধুমাত্র এটা বেচে দেওয়ার কারণ হওয়া উচিৎ নয়। কারণ শর্ট টার্মে বাজারে উপর নিচ চলতেই থাকবে। কোম্পানি যদি ভালো হয় এবং তার ভিতরে কোনও সমস্যা না থাকে তাহলে বেচা তো উচিৎ নয়ই বরং সম্ভব হলে কম দামে আরও কোয়ান্টিটি বাড়িয়ে নেওয়া উচিৎ।

তবে কখনোও খুবই কম সময়ের মধ্যে হঠাৎ কোনো শেয়ারের দাম অতি-অস্বাভাবিক রকম বেড়ে বা কমে গেলে তার পেছনে কারণটা কী সেটা অনুসন্ধান করতে হবে এবং সিলেবাসের বাইরের কিছু কারণ খুঁজে পেলে কিছু সময়ের জন্য বেচে বা কোয়ান্টিটি কমিয়ে পরে আবার কেনার কথা ভাবা যেতে পারে। তবে এটা অতিরিক্ত অস্বাভাবিক রকম কিছু পরিস্থিতিতে সবদিক বিবেচনা করে তবেই করা যেতে পারে, অন্যথায় নয়।

অর্থনৈতিক পূর্বাভাস শুনে

আজকাল খবরের চ্যানেলগুলোতে সব সময়ই কোনো না কোনো অর্থনীতিবিদ কিছু না কিছু পূর্বাভাস দিয়ে চলেছেন। তাদের মধ্যে কেউ হতাশার সময়ে আশা খোঁজেন আবার কেউ আসার সময় হতাশা। বেশিরভাগ সময়ে এই সমস্ত পূর্বাভাস উপেক্ষা করাই ভালো। এগুলো সাধারণত বাজার বা কোনো শেয়ারের উপর প্রভাব ফেললেও সেটার স্থায়িত্ব বেশি দিনের হয় না। তাই এরকম কোনো পূর্বাভাসের পরিপ্রেক্ষিতে পোর্টফোলিও থেকে কিছু বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেও সঠিক কাজ নয়। 

স্বল্পমেয়াদী অন্যান্য কারণে

অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের মতোই বিভিন্ন সময়ে কোনো কোনো কোম্পানি সম্পর্কে অনেক কিছু নেগেটিভ বা পজিটিভ খবর শোনা যায়। আর একটা কিছু খবর একবার বেরোলেই সেই অনুযায়ী বাজারের এক্সপার্টরা তাদের মতামতের বন্যা বইয়ে দেয়। কিন্তু আসলে ভবিষ্যতে কি হবে সেটা কিন্তু কেউ-ই জানে না।

যদি কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল্‌স ঠিক থাকে তাহলে এই সব খবরের প্রভাব শেয়ারের দামের উপর পড়লেও সেই প্রভাব বেশিদিন টেকে না। তাই বাজারের স্বল্পমেয়াদী এসব কোলাহলের দিকে না কান দিয়ে লং টার্ম বিনিয়োগের উপর ফোকাস করা উচিৎ এবং এভাবে কেবলমাত্র অন্যের মতামতের উপর নির্ভর করে নিজের পোর্টফোলিওতে কোনো রকম পরিবর্তন না করাই উচিৎ।

শেষ কথা

কখন শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া উচিত সেটা জানা একদিকে আর্ট আবার অন্যদিকে সায়েন্স। বেচার অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু প্রকৃত কারণটাকে অনুধাবন করতে পারাই আসল। আবেগকে দূরে রেখে শান্ত মনে নিজের জন্য সঠিক সিদ্ধান্তটা শেষ পর্যন্ত আপনাকে নিজেকেই নিতে হবে।

এই বলে আজকের আর্টিকেল এখানেই শেষ করছি। আশা করি বেচার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এটা আপনার কাজে আসবে। ভালো থাকবেন। 🙂


প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)

একই শেয়ার বারবার কেনাবেচা করা যেতে পারে?

এটা করতে কোনও বাধা নেই কিন্তু এটা করা মানে আসলে ব্রোকারেজে অনেক বেশি চার্জ দেওয়া বা ব্রোকারের পেট ভরানো। তাই কেনা ও হোল্ড করা এর থেকে ভালো বিকল্প।

বিক্রি করার পর কখন টাকা তোলা যায়?

নতুন T+1 সেটেলমেন্ট সাইকেল অনুযায়ী বিক্রি করার পর দিন টাকা তোলার জন্য রিকোয়েস্ট করা যায়।

মন্তব্য করুন