আমরা পড়াশোনা করি বা আমাদের বাবা-মা রা আমাদের পড়াশোনা করান প্রধান একটা উদ্দেশ্যেই, সেটা হচ্ছে পড়াশোনা শেষে টাকা ইনকাম করা। আর এর জন্য পুরনো ধ্যান-ধারণার মধ্যবিত্তদের মনে চাকরি ছাড়া আর কোনো কিছুই আসে না।
কিন্তু আজকের এই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে চাকরি না করেও অনলাইনে ইনকাম করার বিবিধ রাস্তা খুলে গেছে।
কিন্তু অনলাইনে ইনকামের যে কোনো রাস্তাই অনুসরণ করা হোক না কেন, কিছু বিশেষ স্কিল বা দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে। ওই সমস্ত প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্কুলের গতানুগতিক পড়াশোনার সময় আয়ত্ত করা যায়না।
এই নিবন্ধে এমনই কিছু স্কিলের কথা জানতে পারবেন যেগুলো অনলাইনে যেকোনো উপায়ে ইনকাম করার ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজনীয়।
অনলাইনে ইনকামের বিভিন্ন উপায়
আসল বিষয়বস্তু শুরু করার আগে এই জিনিসটা না বলে নিলেই নয়। আজকের দিনে অনলাইনে আয় করার হাজারো উপায় আছে। তবে তার মধ্যে কয়েকটা জনপ্রিয় এবং ভীষণ ভালো উপায় হল,
- ব্লগিং বা লিখিত কন্টেন্ট বানানো
- ভ্লগিং বা ভিডিও কনটেন্ট বানানো
- অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং বা অ্যাফিলিয়েট লিংক শেয়ার করা
- ফ্রিল্যান্সিং-এর মাধ্যমে বিভিন্ন রকম কাজ করা
- ডিজিটাল ও ফিজিক্যাল প্রোডাক্ট বিক্রি করা
- অনলাইনে পড়ানো বা কোর্স বিক্রি করা
- শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ও ট্রেড করা
- সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার হওয়া
- প্রিন্ট অন ডিমান্ড
- ই-বুক বিক্রি করা
ইত্যাদি।
অনলাইনে আয় করার সুবিধা
অনলাইনে আয় করতে পারলে যেমন বেকারত্বের যন্ত্রণা নিয়ে এই চাকরির আকালের দিনে চাকরি-র আশায় বসে থাকতে হয় না তেমনই আবার নিজেই নিজের বস হয়ে জীবনে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করা যায়। এছাড়াও এভাবে আয় করার অনেক সুবিধা যেমন,
- কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুরু করার সময় অল্প ইনভেস্টমেন্ট লাগলেও অনেক ক্ষেত্রে বিনা ইনভেস্টমেন্টেই কাজ শুরু করা যায়।
- বাড়িতে বসে নিজের সুবিধামতো সময়ে কাজ করা যায়।
- অনলাইনে আয় করতে হলে যে সমস্ত দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে তার অনেক কিছুই অনলাইনে বিভিন্ন আর্টিকেল পড়ে বা ভিডিও দেখে আয়ত্ত করে নেওয়া যায়।
- চাইলে এবং সময় পেলে একসাথে অনেকগুলো কাজও করা যায়।
- যেকোনো ধরনের কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে একবার কনটেন্ট বানিয়ে তার ফল লম্বা সময় ধরে পাওয়া যায়।
- সারা পৃথিবীব্যাপী মানুষদের টার্গেট করা যায়।
- আয়ের কোনো ঊর্ধ্ব সীমা নেই। ঠিক করে কাজ করতে পারলে বিশাল টাকা আয় করা যায়।
অনলাইনে আয় করার অসুবিধা
সুবিধা অনেক কিছু হলেও এক্ষেত্রে কিছু অসুবিধাও আছে। সবথেকে বড় অসুবিধা হচ্ছে ইনকাম শুরু হতে বেশ সময় লাগে এবং শুরু হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস এবং অবিচল সঙ্কল্প বজায় রেখে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যেতে হয়। তবে ঠিকভাবে চলতে পারলে সাফল্য একদিন ঠিকই আসে।
আরও একটা অসুবিধা হচ্ছে অনলাইনে বেশীরভাগ কাজের ক্ষেত্রেই বন্ধ ঘরে লড়াইটা একাকেই চালিয়ে যেতে হয়।
অনলাইনে ইনকাম করার জন্য প্রয়োজনীয় স্কিল
অনলাইনে ইনকাম করতে হলে কিছু দক্ষতা বা স্কিল প্রায় সব ক্ষেত্রেই কাজে লাগে আবার কিছু স্কিল বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এখানে সব থেকে প্রয়োজনীয় এ ধরনের কিছু স্কিলের বিবরণী দেওয়া হল —
কম্পিউটারের জ্ঞান
অনলাইনে কাজ করতে হলে কম্পিউটার জানা মাস্ট। হ্যাঁ অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু কাজ মোবাইলেও করা যায় তবে প্রফেশনাল কাজ বা তাড়াতাড়ি গুছিয়ে কাজ মোবাইলে ঠিক হয় না।
অনলাইনের প্রায় সমস্ত কাজেই কম্পিউটার ব্যবহার করার দরকার পড়ে। যেকোনো ধরনের কনটেন্ট বানানো এবং এডিট করা, রিসার্চ করা, ওয়েবসাইট বা প্রোফাইল ম্যানেজ করা, ফ্রিল্যান্সিং বা অন্য বিভিন্ন রকম ডিজিটাল কাজ করা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই কম্পিউটারের ব্যবহার অপরিহার্য।
কম্পিউটারের যে যে বিষয়গুলো এক্ষেত্রে জানা জরুরী সেগুলো হল,
- কম্পিউটারের বেসিক ফান্ডামেন্টালস
- ওয়েব ব্রাউজার ও ইন্টারনেটের ব্যবহার
- মাইক্রোসফট অফিস
- ফটো ও ভিডিও এডিট করা
- বিভিন্ন রকম সফটওয়্যার ইনস্টলেশন ও ম্যানেজমেন্ট
- অল্পস্বল্প কোডিং
ইত্যাদি।
এক বা একাধিক ভাষার উপর দক্ষতা
অনলাইনে যা কিছু করতে চাওয়া হোক, ইংরেজি ভাষার উপর দখল থাকলে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। এই ভাষা ভালো করে জানলে যেমন অনেক অপশন পাওয়া যায় তেমনই আবার সারা পৃথিবীব্যাপী বেশিরভাগ মানুষকে টার্গেট করা যায়। আর ইংরেজি ভাষাভাষী বাইরের বিভিন্ন দেশের কাস্টমারকে টার্গেট করলে অনেক সময় আয় অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এছাড়া কোনো কিছু জানতে হলে বা কোনো বিষয়ে রিসার্চ করতে হলে অনেক সময় ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে সেরকম তথ্য পাওয়া যায় না।
ইংরেজি ছাড়া নিজের মাতৃভাষায় দারুন দখল থাকলেও কাজ চালানো যায়। তবে এক্ষেত্রে টার্গেটেড কাস্টমার শুধু নিজের ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
তবে বাংলা মাতৃভাষা হলে সম্ভাবনা মোটেও কম না, কারণ বিশ্বের পঞ্চম বহুল ব্যবহৃত ভাষা হল এই বাংলা। আর এই ভাষায় পৃথিবীতে 30 কোটিরও বেশি মানুষ কথা বলেন।
আবার বাংলা যাদের মাতৃভাষা তারা অনেকে হিন্দিটাও বোঝেন বা ব্যবহার করতে পারেন। তাই কেউ যদি বাংলার সাথে সাথে হিন্দিটারও প্রয়োগ করতে পারেন তাহলে টার্গেটটা আরো অনেকটা বাড়িয়ে নেওয়া যায়।
লেখার ক্ষমতা
এই একটা স্কিল স্কুল থেকেই অর্জন করা যায়। স্কুলের পাঠ এবং পরীক্ষাগুলোয় ভালোভাবে অংশ নিলে মোটামুটি একটা লেখার ক্ষমতা তৈরি হয়েই যায়। আর কাজের সময় বা ব্যবহারের সময় এর যত প্রয়োগ করা হয় এব্যাপারে ধার ততই বাড়তে থাকে।
অনলাইনে ব্লগ বানিয়ে আর্টিকেল পাবলিশ বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও পোস্ট করা, কোনও কিছুর বিবরণী বা প্রোমোশন, ই-বুক লেখা বা ইমেল পাঠানো ইত্যাদি এধরনের বহু ক্ষেত্রেই নির্ভুল ও উচ্চমানের লেখার প্রয়োজন পড়ে পদে পদে।
কথা বলার ক্ষমতা
এই ক্ষমতাটা আবার ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চারদের সাধারনত ভালো হয়। কারণ তারাই ক্লাস চলাকালীন সময়ে এবং অন্য সময়েও বন্ধুদের সাথে গল্প ও আড্ডায় বেশি মেতে থাকে।
ক্লাসের প্রথম দিকের ছাত্রছাত্রীরা যে সবসময় এক্ষেত্রে দুর্বল হয় তা নয়, তবে ছোটো থেকে যত বেশি অনর্গল কথা বলা হয়, এই ক্ষমতা বা দক্ষতাটা তত ভালো তৈরি হয়। আর প্রথম দিকের ছাত্রছাত্রীদের সাধারণত বইতে মুখ গুঁজে পড়াশোনা করা বাদে অন্যকিছুতে মাথা দেওয়ার সময়ই থাকেনা।
ভালো ভিডিও বা অডিও কনটেন্ট বানাতে, সুন্দর গল্প বলতে, কোনো কিছু বিষয় সুন্দর ভাবে বোঝাতে এবং মানুষের মন জয় করতে ভালো কথা বলার বিকল্প কোনোকিছুই নেই।
ফটো ও ভিডিও শুটিং এবং এডিটিং
কথায় আছে ‘প্রথমে দেখনদারি পরে গুন বিচারি’। অনলাইনে যা কিছুই করতে যাওয়া হোক না কেন, ভালো করে প্রেজেন্ট করাটা খুবই জরুরী।
আর সেকারনেই আজকাল অনলাইনে সব জায়গাতেই ছবি এবং ভিডিওর ব্যবহার মুহুর্মুহু। ওয়েবসাইট বা ব্লগেই হোক, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট বা বিভিন্নরকম অ্যাড কিংবা প্রমোশনেই হোক ছোটো-বড় হরেক রকম ছবি এবং শর্ট-লং ভিডিও কনটেন্টের চাহিদা আকাশছোঁয়া।
আর এই বিশাল সম্ভাবনার জায়গায় কিছু করতে হলে, সে নিজের জন্যই হোক বা ক্লায়েন্টের জন্য, ভালো করে ফটো বা ভিডিওগ্রাফি যেমন শেখার দরকার, তার সাথে দরকার সুন্দর করে এডিটিং শেখা।
যেকোনো একটা বিষয়ে প্যাশান এবং গভীর জ্ঞান
উপরের সবকটা দক্ষতার ঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হলে এই কটা দক্ষতার মধ্যে কোনও একটায় কিংবা এর বাইরের কোনও একটা বিষয়ে প্যাশান ও শেখার অদম্য ইচ্ছা এবং গভীর জ্ঞান ও নৈপুণ্য থাকতে হবে। তাহলেই সেটাকে কেন্দ্র করে এই দক্ষতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে দারুন একটা ফল পাওয়া যেতে পারে।
উদাহরনঃ
ধরে নিই উপরে উল্লিখিত স্কিলগুলোর মধ্যে ফটো তোলা কারও প্যাশান এবং ফটোগ্রাফিতে সে ভীষণভাবে এক্সপার্ট।
তো সে তার এই প্যাশানকে কেন্দ্র করে,
- প্রথমত, ফটো তুলে ডিজিটাল আইটেম হিসাবে অনলাইনে বিক্রি করতে পারবে।
- দ্বিতীয়ত, ইন্সটাগ্রামের মতো ছবি কেন্দ্রিক সোশ্যাল মিডিয়াতে তোলা ফটো শেয়ার করে ফ্যান ফলোইং তৈরি করে সেখানে পরে স্পন্সরড কনটেন্ট পোস্ট করে আয় করতে পারবে।
- তৃতীয়ত, একটা ব্লগ বানিয়ে ফটোগ্রাফির আদবকায়দা শিখিয়ে অনেক রিডার হলে তাদের অ্যাড দেখিয়ে আয় করতে পারবে।
- চতুর্থত, ব্লগের মতো ভিডিও বানিয়ে ভ্লগিং করতে পারবে।
- পঞ্চমত, অনলাইনে কোর্সের মাধ্যমে ফটোগ্রাফি শেখাতে পারবে।
- এই বিষয়ের মতো কিন্ডল বুক পাবলিশিং-এর মাধ্যমে ই-বুক এমনকি সাধারণ বই লিখে বিক্রি করে রয়ালিটি পেতে পারবে।
- নিজের অনলাইন পোর্টফলিও ওয়েবসাইট বানিয়ে ফ্রীল্যান্স প্রোজেক্ট পেতে পারবে।
- উপরের অনেক ক্ষেত্রেই আবার অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং ও স্পন্সরশিপের মাধ্যমে এক্সট্রা ইনকাম করতে পারবে।
এইরকম উপায় আরও আছে। কোনও একটা বিষয়ে দারুন এক্সপার্ট হলে অপারচুনিটির শেষ নেই। এখানে উল্লিখিত স্কিলগুলোর বাইরে কোনোকিছুতে প্যাশান থাকলেও একইভাবে উপরের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করে প্রচুর ইনকাম করা যায়।
শেষ কথা
উপরিউক্ত স্কিলগুলো ছাড়াও আরও অনেক স্কিল কাজে আসে। তবে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার অনলাইনে সাফল্য পেতে সবকটা গুণই যে থাকতে হবে তারও কোনো কথা নেই। যেমন ব্লগিং করতে চাইলে লেখার ক্ষমতাটা প্রয়োজনীয়, আর এক্ষেত্রে ভালো কথা না বলতে পারলেও সমস্যা হয় না। তেমনই আবার ভ্লগিং-এর ক্ষেত্রে ভালো কথা বলা, ক্যামেরার সামনে সাবলিল হওয়া জরুরী। সেক্ষেত্রে লেখালেখিতে ভালো না হলেও চলে।
অনলাইনে যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সমস্ত স্কিল গুলোর মধ্যে কোনোটায় দুর্বল হলে কয়েকজন বন্ধু মিলে পার্টনারশিপে কাজ শুরু করা যায়। এক্ষেত্রে একজনের দুর্বলতা অন্যজনের দক্ষতা দিয়ে ম্যানেজ করে নেওয়া যায়।
শেষকালে একটাই কথা বলবো, একটু সাহস করে শুরু করে লেগে থাকতে পারলে অনলাইনে ইনকামের সম্ভাবনা অসীম। তাই আপনি ছাত্র, ট্র্যাডিশনাল ব্যবসায়ী বা চাকুরীরত যাই হোন না কেন, পার্টটাইম হিসেবে নিজের পছন্দমত যেকোনো একটা রাস্তায় কাজ শুরু করতে পারেন। কে বলতে পারে কাল কার কপালে কি লেখা আছে !