শেয়ার বাজারে কেনাকাটা করতে গেলে দেখা যায় বিনিয়োগের জন্য সেখানে হাজার হাজার কোম্পানি উপস্থিত। আর তাদের শেয়ারের যেমন আলাদা আলাদা নাম তেমনই তাদের আলাদা আলাদা দাম। সেখানে যেমন ৮০ হাজার টাকার থেকে বেশি দামের শেয়ারও আছে তেমনই আবার এক টাকার থেকে কম দামের শেয়ারও আছে।
তবে শেয়ারের দাম কিন্তু কোম্পানির গুনমানের ব্যাপারে সরাসরি কিছু নির্দেশ করেনা। ভালো শেয়ার বাছাই করার ক্ষেত্রে এর দাম তেমন কোনো গুরুত্ব পায়না। তবে সাধারণত শেয়ারের দাম খুব কম হলে সেগুলোকে পেনি স্টক বলে আর রুল অফ থাম্ব হচ্ছে এক্ষেত্রে কোম্পানিটার মার্কেট ক্যাপ সাধারণত খুব কম হয় আর এধরণের শেয়ারের দামের ওঠানামা হয় খুব বেশি। এবং সেজন্য পেনি স্টকে বিনিয়োগ ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধরা হয়। আবার অন্যদিকে যাদের শেয়ারের দাম খুব বেশি সাধারণত সেগুলোকে প্রিমিয়াম স্টক হিসাবে ধরা হয়। তবে দাম বেশি মানেই জে সেটা বিনিয়োগের জন্য আদর্শ সেটা কিন্তু একেবারেই নয়।
এই নিবন্ধে আমরা ভারতের শেয়ারবাজারে লিস্টেড কোম্পানিগুলোর মধ্যে সব থেকে দামী দশটা শেয়ারের ব্যাপারে আলোকপাত করবো। তবে এদের গুণমান বিচার করা বা বিনিয়োগের জন্য আদর্শ শেয়ার খোঁজা এই নিবন্ধের লক্ষ্য না।
এম আর এফ (৮৩৭০০ টাকা)
এই তালিকার প্রথম নাম এম আর এফ। মাদ্রাজ রাবার ফ্যাক্টরি এর পুরো নাম। ভারতের সবথেকে দামী শেয়ারের শিরোপা এরই প্রাপ্য। সেই শচীন টেন্ডুলকার যখন ক্রিকেট খেলত তখন ওনার ব্যাটে এমআরএফ লেখা থাকতো মানে এই নয় যে শচীনের ব্যাটের কোম্পানি এটা! এর আসল কাজ হচ্ছে সরু-মোটা, গোল-গোল, কালো রং-এর, বিভিন্ন সাইজের এবং দারুন গুণমানের টায়ার বানানো, বিভিন্ন ধরণের যানবাহনে ব্যবহারের জন্য।
টায়ার ছাড়াও এই কোম্পানি রং আর খেলাধুলার জিনিসপাতি তৈরির সাথেও যুক্ত। বাচ্ছাদের খেলনা তৈরির ব্র্যান্ড ফানস্কুল এরই মালিকাধীন।
এর এত দাম হওয়ার পিছনে একটা কারণ হচ্ছে লিস্ট হওয়ার পর থেকে কক্ষনো স্প্লিট করা হয়নি, তাছাড়া এর ফান্ডামেন্টালসও খুব স্ট্রং।
এম আর এফ-এর বর্তমান মার্কেট ক্যাপ ৩৫ হাজার ৫০০ কোটির মত। ২০০৩ সালে এই শেয়ারের দাম ছিল ৯০০ টাকার কাছাকাছি। আর এখন এর দাম ৮৩৭০০। মানে বিগত কুড়ি বছরের বুঝতে পারছেন তো, এর দাম কোন জায়গা থেকে কোথায় গেছে! এর মাঝে ২০২১ সালে একবার তো এর দাম ৯৮০০০ কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল! ৯০০ থেকে ৯০ হাজার মানে বিনিয়োগের বৃদ্ধি ১০০ গুণ!
হানিওয়েল অটোমেশন ইন্ডিয়া লিমিটেড (৩৬৫০০ টাকা)
দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে হানিওয়েল অটোমেশন ইন্ডিয়া লিমিটেড। এটা হেল নামেও পরিচিত। হেল মানে নরক HELL না, এই হেল হচ্ছে HAIL। ১৯৮৭ সালে মানে আমার জন্মের ঠিক এক বছর আগে টাটা দের সাথে আমেরিকার হানিওয়েল গ্রুপের গাঁটছড়া বেঁধে এই কোম্পানিটা তৈরি হয়েছিল, যদিও পরে ২০০৪ সালে টাটা দের থেকে পুরো মালিকানা ফিরিয়ে নিয়ে এটা একটা স্বাধীন কোম্পানিতে পরিণত হয়।
এরা প্রধানত অন্যান্য ব্যবসার জন্য সফটওয়্যার ও অটোমেশনের কাজ করে। এছাড়া এদের কাজকর্ম তেল ও গ্যাস শোধন করা, কাগজ ও প্রিন্টিং, পাওয়ার জেনারেশন, ইলেকট্রনিক্স হার্ডওয়ার তৈরি, ফায়ার ডিটেকশন সিস্টেম তৈরি ইত্যাদি বিবিধ ক্ষেত্রে বিস্তৃত।
এরা যে শুধুমাত্র এদেশেই সার্ভিস দেয় তা নয়। সারা পৃথিবী ব্যাপী 100 টারও বেশি দেশে ১ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি কর্মচারী নিয়ে এরা কাজ করে।
বর্তমানে এর মার্কেট ক্যাপ ৩২ হাজার ৩০০ কোটির কিছু বেশি। ২০০৩ সালে এর একটা শেয়ারের দাম ছিল ২৫০ টাকার আশেপাশে। আর কুড়ি বছর পরে এখন সেই দাম পৌঁছেছে ৩৬ হাজার ৫০০ টাকার কাছাকাছি। ২০২১ সালে একবার এই দাম সর্বকালীন সর্বোচ্চ হিসাবে ৫০ হাজারও ছুঁয়ে এসেছে। দুই দশক আগে এতে সামান্য কিছু বিনিয়োগ করলেও তা আজকের দিনে কোথায় যেতে পারতো বুঝতে পারছেন?
পেজ ইন্ডাস্ট্রিজ (৩৬৪৫০ টাকা)
পেজ ইন্ডাস্ট্রিজ হল ভারতের সবথেকে দামী শেয়ার গুলোর মধ্যে তৃতীয়। এই পেজ শব্দটা আছে বলে ভাববেন না যেন এটা একটা কাগজের কোম্পানি। আমাদের জামা কাপড় খুললেই সব থেকে প্রথমে যে জিনিসটা নজরে আছে সেটা হচ্ছে এই পেজ ইন্ডাস্ট্রিজের প্রোডাক্ট। এরা আন্ডারওয়্যার বানায় আর কি। জকি নামটা শুনেছেন তো। ভারত এবং তার সঙ্গে নেপাল, বাংলাদেশ, ইউ এ ই আর শ্রীলঙ্কায় ব্যবহৃত জকি ব্র্যান্ডের সমস্ত প্রোডাক্ট এদেরই বানানো।
এখন এর মার্কেট ক্যাপ ৪০ হাজার কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ২০০৭ সালে শেয়ার বাজারে এর যাত্রা শুরু হওয়ার সময় এর দাম ছিল ২৫০ টাকার কাছাকাছি। ১৬ বছর পরে এখন এর দাম ৩৬ হাজার ৪৫০ টাকার কাছাকাছি। এর মাঝে 2022 সালে একবার এর সর্বোচ্চ দাম ৫৪ হাজারে পৌঁছে গিয়েছিল। ২০০৭ সালে মাত্র ১০০০ টাকা খরচ করে এই কোম্পানির চারটে শেয়ার কিনলে ২০২২ সালে তার ভ্যালু ২ লাখেরও বেশি হতো।
শ্রী সিমেন্ট (২৬১০০ টাকা)
আপনি যদি আইপিএল দেখেন এবং দলগুলোর সাথে পরিচিত থাকেন তাহলে খেয়াল করে থাকবেন ধোনির দল মানে চেন্নাই সুপার কিংস দলটার মালিক হচ্ছে শ্রী সিমেন্ট। ভারতের সবথেকে দামী শেয়ার গুলোর মধ্যে এর স্থান চতুর্থ। এদের হেডকোয়ার্টার অবস্থিত কল্লোলিনী কলকাতায়। এটা ভারতবর্ষের সবথেকে বড় সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটা।
শেয়ারের দাম অনুযায়ী এটা চতুর্থ স্থানে থাকলেও প্রথম তিনটে কোম্পানির থেকে মার্কেটক্যাপে এটা অনেক এগিয়ে। এর মার্কেট ক্যাপ 94 হাজার কোটিরও বেশি। বর্তমানে এর একটা শেয়ারের দাম চলছে ২৬১০০ টাকার আশেপাশে। কুড়ি বছর আগে ২০০৩ সালে এর দাম ছিল ৫০ টাকার কাছাকাছি। আর ২০২১ সালে এর সর্বোচ্চ দাম ছুঁয়েছিল ৩২ হাজার। ২০০৩ সালে মাত্র ২০০ টাকা খরচ করে এই কোম্পানির ৪টে শেয়ার কিনলে এখন আপনার সঞ্চয়ে ১ লাখেরও বেশি থাকতো!
থ্রি এম ইন্ডিয়া (২৩৩৫০ টাকা)
এটা আমেরিকার পেরেন্ট থ্রি এম কোম্পানির একটা সাবসিডিয়ারি। তালিকায় এর স্থান পঞ্চম। এই কোম্পানি আলাদা আলাদা রকমের প্রোডাক্ট তৈরি বা সার্ভিস দেওয়ার সাথে যুক্ত। বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের ফিল্ম বা পর্দা, আঠা, পরিষ্কার করার জিনিসপত্র, স্টেশনারি আইটেম ইত্যাদি এরা তৈরি করে থাকে। আপনার বাড়িতে স্কচ ব্রাইটের কিছু না কিছু আইটেম আশা করি ব্যবহার হয়েই থাকে। আরও অন্যান্য জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের পাশাপাশি স্কচ ব্রাইটের সমস্ত প্রোডাক্ট এরাই উৎপাদন করে।
এই কোম্পানির মার্কেট ক্যাপ 26 হাজার 300 কোটি। ২০০৩ সালে ২৫০-৩০০ রেঞ্জ থেকে ২০২১ সালে সর্বোচ্চ দাম 31 হাজার ছুঁয়ে এখন এর একটা শেয়ারের দাম ২৩৩৫০ টাকা।
অ্যাবট ইন্ডিয়া (২২৯০০ টাকা)
বর্তমানে সবথেকে দামী শেয়ারের কোম্পানিগুলোর মধ্যে এই কোম্পানি ষষ্ঠ। এটা ভারতের সবথেকে বড় ফার্মা কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটা। আমেরিকার অ্যাবট ল্যাবের সাবসিডিয়ারি হচ্ছে এই অ্যাবট ইন্ডিয়া। ওষুধ ছাড়াও এরা বাচ্ছাদের বিবিধ নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্টারি প্রোডাক্টও তৈরি করে। আপনার বাড়িতে কোন কচিকাঁচা থাকলে আশা করি পিডিয়াসিওর নামটা শুনে থাকবেন। পিডিয়াসিওর-এর সমস্ত প্রোডাক্ট এই কোম্পানিরই তৈরি।
৪৮ হাজার ৬০০ কোটি মার্কেট ক্যাপ নিয়ে এই কোম্পানির একটা শেয়ারের বর্তমান দাম ২২ হাজার ৯০০। ২০০৩ সালে ৩০০ টাকা থেকে কুড়ি বছরের এই বৃদ্ধি অসাধারণের থেকে কোনো অংশে কম না।
নেসলে ইন্ডিয়া (১৯৭০০ টাকা)
সুইজারল্যান্ড স্থিত পেরেন্ট কোম্পানি নেসলের সাবসিডিয়ারি হচ্ছে এই তালিকার সপ্তম নেসলে ইন্ডিয়া। ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে খুবই চেনা নাম এই নেসলে। রোজকার জীবনে এদের বিভিন্ন প্রোডাক্ট আমরা খেতে খুবই পছন্দ করি। ম্যাগি, নেসক্যাফে, কিটক্যাট, মিল্কমেড ইত্যাদি ব্র্যান্ড গুলোর সাথে আমরা সকলেই ভীষণ ভালোভাবেই পরিচিত। আর এই সবকটা ব্র্যান্ড এই কোম্পানিরই ক্যাটালগের অংশ।
দু দশক আগে ৫০০ থেকে বর্তমানে এর একটা শেয়ারের দাম ১৯৭০০ টাকা, মানে বিনিয়োগের বৃদ্ধির হার ৪০ গুন! আর এর মার্কেট ক্যাপ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটিরও বেশি। মানে মার্কেট ক্যাপের বিচারে এই তালিকার সবথেকে বড় কোম্পানি এটাই।
বস (১৮৮০০ টাকা)
নাম বস হলেও শেয়ারের দামের বিচারে এর স্থান অষ্টম। এই কোম্পানিটা জার্মানির রবার্ট বস কোম্পানির একটা অংশ। খুব ভালো মানের মটর তৈরির জন্য এরা বিখ্যাত। আর মটর দরকার পড়ে, এদের এ ধরনের নানাবিধ অ্যাপ্লায়েন্স যেমন ওয়াশিং মেশিন, মিক্সার গ্রাইন্ডার, ফুড প্রসেসর ইত্যাদি খুব ভালো মানের হয়। এছাড়াও এরা অটোমেটিভ টেকনোলজির অন্তর্গত ডিজেল ও গ্যাসোলিন ফুয়েল ইনজেকশন সিস্টেম, গাড়ির মাল্টিমিডিয়া সিস্টেম, অটো ইলেকট্রিক্যালস ইত্যাদি ম্যানুফ্যাকচারিং-এর সাথে যুক্ত।
২০০৩ সালে ৩৫০ থেকে ২০১৫ তে ২৮ হাজার ছোঁয়ার পর বর্তমানে এই কোম্পানির একটা শেয়ারের দাম ১৮৮০০, আর এর মার্কেট ক্যাপ ৫৫ হাজার ৫০০ কোটি।
প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল হাইজিন (১৪০৫০ টাকা)
ভারতের ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস বা এফএমসিজি কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম এই প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল হাইজিন বা পি অ্যান্ড জি। এদের পোর্টফোলিওতে যেমন মেয়েদের হাইজিন সম্পর্কিত ব্র্যান্ড হুইসপার আছে, তেমনি আছে প্যামপার্স, জিলেট, ভিক্স, ওরাল-বি, প্যান্টিন, পিউমা ইত্যাদি বহু ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় নানান ব্র্যান্ড।
এর বর্তমান মার্কেট ক্যাপ ৪৫ হাজার ৭০০ কোটি। ২০০৪ সালে ৪০০ টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু হওয়ার পর 19 বছরে দাম বেড়ে এর একটা শেয়ারের দাম ১৪০০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
কামা হোল্ডিংস (১২২০০ টাকা)
এই তালিকার অন্তিম তবে নতুন সদস্য কামা হোল্ডিংস। এডুকেশন, রিয়েল এস্টেট আর ইনভেস্টমেন্ট এরিয়াতে তিনটে সাবসিডিয়ারি যথা শ্রী এডুকেয়ার লিমিটেড, কামা রিয়েলিটি লিমিটেড এবং এসআরএফ ট্রানজেকশনাল হোল্ডিংস লিমিটেডের মাধ্যমে এরা ব্যবসা করে।
মাত্র চার বছর আগে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকায় এর যাত্রা শুরু হওয়ার পর এখন এই কোম্পানির একটা শেয়ারের দাম ১২২০০ টাকায় পৌঁছেছে। দামটা বেশি হলেও মার্কেট ক্যাপের দিক থেকে এই কোম্পানি কিন্তু এই তালিকার অন্যান্য কোম্পানিগুলোর থেকে অনেকটাই ছোট। এর মার্কেট ক্যাপ ৭৮০০ কোটি।
শেষ কথাঃ
আগেও বলেছি আবারো বলছি উপরে দেওয়া শেয়ারের এই তালিকা বিনিয়োগ করার কোনো পরামর্শ নয় কিন্তু। যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো শেয়ারের হদিস পাওয়ার পর সেব্যাপারে বিস্তারিত রিসার্চ করে তবেই বিনিয়োগের ব্যাপারে অন্তিম সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
আজ তাহলে এখানেই শেষ করি। ভালো থাকবেন।
সুত্রঃ স্ক্রীনার