বিনিয়োগের এক বিকল্প হিসেবে মিউচুয়াল ফান্ড ইদানিং খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিগত 10 বছরে ভারতবর্ষে মিউচুয়াল ফান্ডে ইনভেস্টমেন্ট পাঁচ গুণ বেড়ে এখন সর্বমোট বিনিয়োগের পরিমাণ হয়েছে 40 লাখ কোটির মত। আর এখনো পর্যন্ত এধরনের অ্যাকাউন্ট বা ফোলিওর সংখ্যা পৌঁছেছে 14 কোটিতে।*
আপনিও কি বিনিয়োগের এই মাধ্যমে অংশগ্রহণ করেছেন? নাকি এই পথে বিনিয়োগের কথা ভাবছেন? উত্তরটা যাই হোক না কেন মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগে আগ্রহী হলে এই নিবন্ধে জানতে পারবেন এক্ষেত্রে কী কী উপায়ে বিনিয়োগ করা যায়।
মিউচুয়াল ফান্ড আসলে কী?
মিউচুয়াল ফান্ডের আক্ষরিক বাংলা অর্থ পারস্পরিক তহবিল। অনেক বিনিয়োগকারীদের টাকা একসাথে জড়ো করে যখন কোনো একটা রেজিস্টার্ড ট্রাস্ট বিনিয়োগের একটা সাধারণ উদ্দেশ্যে ইকুইটি, বন্ড, মানি মার্কেট ইন্সট্রুমেন্ট বা অন্যান্য সিকিউরিটি গুলোতে একটা নির্দিষ্ট থিমের উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করে তখন সেটাকে মিউচুয়াল ফান্ড বলা হয়। আর এক্ষেত্রে যা আয় হয় তা সমস্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনিয়োগের আনুপাতিক হারে ভাগ করে দেওয়া হয়।
বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রদেয় অর্থ অনুযায়ী পুরো ফান্ডের ইউনিট হিসাবে কিছু ইউনিটের মালিকানা পান। তাছাড়া এতে যে কেবলমাত্র শুরুতেই বিনিয়োগ করা যায় তা নয়, ফান্ড গঠিত হওয়ার পরেও বিনিয়োগ করা যায় এবং সে ক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ করা টাকার বিনিময়ে তখনকার ইউনিটের ভ্যালু অনুযায়ী ইউনিট পান।
প্রত্যেক মিউচুয়াল ফান্ডে এক্সপার্ট ফান্ড ম্যানেজাররা থাকেন যারা ঠিক করেন কোন ধরনের ইন্সট্রুমেন্টে কখন কত পরিমাণে বিনিয়োগ করা হবে।
সোজা বাংলা কথায় মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা মানে আসলে সবাই মিলে এক্সপার্টদের হাতে টাকা তুলে দেওয়া যাতে তারা অল্প চার্জের বিনিময়ে আমাদের হয়ে বিনিয়োগ করতে পারে এবং আমরা বিনিয়োগের খুঁটিনাটি, পদ্ধতিগত ঝামেলা ও ঝুঁকির মধ্যে না পড়েই বিনিয়োগে অংশ নিতে পারি।
ভারতের সেরা কয়েকটা মিউচুয়াল ফান্ড হাউস
বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন মেটাতে ভারতবর্ষে বহুসংখ্যক মিউচুয়াল ফান্ড হাউস গঠিত হয়েছে। এই ফান্ড হাউস গুলোই হল সেবি রেজিস্টার্ড ট্রাস্ট যারা বিবিধ ফান্ড ম্যানেজ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতকগুলো হলো…
- এসবিআই মিউচুয়াল ফান্ড
- আইসিআইসিআই প্রুডেন্সিয়াল এমএফ
- এইচডিএফসি এমএফ
- আদিত্য বিড়লা সান লাইফ এমএফ
- কোটাক মাহিন্দ্রা এমএফ
- নিপ্পন ইন্ডিয়া এমএফ
- অ্যাক্সিস এমএফ
- ইউটিআই এমএফ
- আইডিএফসি এমএফ
- ডি এস পি এমএফ
ইত্যাদি। পুরো তালিকা এই লিংক থেকে দেখে নিতে পারবেন।
এই ফান্ডের দুই ধরণের প্ল্যান
প্রত্যেক মিউচুয়াল ফান্ড স্কিমে দুই ধরনের প্ল্যান হয়, যথা রেগুলার আর ডাইরেক্ট প্ল্যান।
একটা ফান্ড পরিচালনা করতে ম্যানেজমেন্ট ফী, রেজিস্ট্রার ফী ও ট্রাস্টি ফী এছাড়াও মার্কেটিং-এর খরচ ও ডিস্ট্রিবিউশনের খরচ মিলিয়ে মোট যে খরচ হয় সেটাকে টোটাল এক্সপেন্স রেশিও বা টিইআর বলে।
বিভিন্ন দালাল বা ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমে এতে বিনিয়োগ রেগুলার প্ল্যান এর মধ্যে পড়ে এবং এই প্ল্যানে পুরো টিইআর লাগে।
সরাসরি ফান্ড হাউসের মাধ্যমে কিংবা সেবি রেজিস্টার্ড ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজার্স বা আরআইএ-র মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করলে সেটা ডাইরেক্ট প্ল্যান এর মধ্যে পড়ে। ডাইরেক্ট প্ল্যানে ডিস্ট্রিবিউশন-এর খরচটার প্রয়োজন পড়েনা তাই টিইআর কম হয়।
মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের বিবিধ মাধ্যম
মিউচুয়াল ফান্ডের রেগুলার বা ডাইরেক্ট প্ল্যানে বিনিয়োগ করতে চাইলে নিজের চাহিদামত বা সুবিধামত বিভিন্ন ধরণের এজেন্ট বা দালালের সাহায্যে করা যেতে পারে আবার সরাসরিও করা যেতে পারে। যেমন…
1. ডিস্ট্রিবিউটর-এর মাধ্যমে বিনিয়োগ
অ্যাসোসিয়েশন অফ মিউচুয়াল ফান্ডস ইন ইন্ডিয়া বা এএমএফআই দ্বারা রেজিস্টার্ড মিউচুয়াল ফান্ড ডিস্ট্রিবিউটররা বিভিন্ন রকম ফান্ডের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং আপনার বিনিয়োগে সমস্ত রকম সহযোগিতা করে থাকেন।
এদের কাছে মিউচুয়াল ফান্ডের রেগুলার প্ল্যানে বিনিয়োগ করা যায়। এরা সরাসরি বিনিয়োগকারীদের থেকে কোনরকম অতিরিক্ত চার্জ নেয় না। তবে একটু আগেই যা বললাম, এরা ফান্ড হাউসের থেকে ডিস্ট্রিবিউশন কমিশন পায় আর তাই পুরো টিইআর দিতে হয় বলে এদের মাধ্যমে কেনা ফান্ডের ইউনিটের দাম সরাসরি ফান্ড হাউস থেকে কেনা ইউনিটের দামের থেকে সামান্য বেশি পড়ে।
কিন্তু প্রথমবার মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করার সময় এদের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা খারাপ নয় কারণ আপনি এদের সঙ্গে কথা বলে আপনার প্রয়োজন, লক্ষ্য, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদির ওপর বিচার করে আপনার জন্য সঠিক ফান্ড সহজেই বেছে নিতে পারবেন।
আপনার বাড়ির কাছাকাছি এরকম ডিস্ট্রিবিউটরের খোঁজ পেতে চাইলে এই লিংকে গিয়ে নিজের পিন কোড বা ঠিকানা দিয়ে খুঁজে নিতে পারবেন।
বেশীরভাগ ব্যাংক যেমন এইচডিএফসি, অ্যাক্সিস ইত্যাদি এবং বড় বড় স্টক ব্রোকার যেমন জিরোধা (কয়েন), আপস্টক্স, 5পয়সা, আইসিআইসিআই সিকিউরিটিস ইত্যাদির মাধ্যমেও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা যায় কারণ এরা প্রত্যেকেই ব্যাংক বা স্টক ব্রোকার হওয়ার পাশাপাশি ফান্ড ডিস্ট্রিবিউটরও।
2. রেজিস্টার্ড ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজার্স বা আরআইএ-এর মাধ্যমে বিনিয়োগ
এরাও মিউচুয়াল ফান্ড ডিস্ট্রিবিউটরের মতোই তবে এরা সেবি রেজিস্টার্ড। আরও একটা তফাৎ হচ্ছে এদের মাধ্যমে এই ফান্ডের ডাইরেক্ট প্ল্যানে বিনিয়োগ করা যায়। মানে বিনিয়োগকারীকে কোনও ডিস্ট্রিবিউশন চার্জে দিতে হয় না, তবে এরা সাধারণত এদের দেওয়া সার্ভিসের জন্য একটা এককালীন অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ নেয়।
সেবি রেজিস্টার্ড সমস্ত ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজারের ব্যাপারে জানতে চাইলে এই লিংকে গিয়ে জেনে নিতে পারবেন।
3. রেজিস্ট্রারার অ্যান্ড ট্রান্সফার এজেন্টের (আরটিএ) মাধ্যমে বিনিয়োগ
এরা বিভিন্ন ফান্ড হাউসের হয়ে ফান্ড ট্রানজাকশন প্রসেস করে। আবার এরা বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুবিধাও দেয়। একটা আরটিএ একসাথে অনেক ফান্ড হাউসের সাথেই কাজ করে। এবং এরা সেই সমস্ত ফান্ড হাউসে বিনিয়োগের সুযোগও করে দেয়।
এদের মাধ্যমে বিনিয়োগ করার একটা সুবিধা হচ্ছে এরা যে সমস্ত এএমসি-র সাথে এরা কাজ করে সেই প্রত্যেকটা এএমসির-র বিবিধ রেগুলার এবং ডাইরেক্ট দুই রকম প্ল্যানেই বিনিয়োগ করা যায়।
এরকম দুই সুপরিচিত আরটিএ হল কম্পিউটার ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস বা ক্যামস এবং কারভি।
4. সরাসরি ফান্ড হাউসের মাধ্যমে বিনিয়োগ
কোনও রকম এজেন্ট বা দালালের কাছে না গিয়ে সরাসরি ফান্ড হাউসের মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ডের ডাইরেক্ট প্ল্যানে বিনিয়োগ করা যায়। এক্ষেত্রে ডিস্ট্রিবিউশন চার্জ প্রযোজ্য না হওয়ার জন্য টোটাল এক্সপেন্স রেশিও কম হলেও বিনিয়োগের জন্য পছন্দমত ফান্ড বেছে নেওয়া এবং অ্যাপ্লাই করা, ম্যানেজ করা ইত্যাদি সবকিছু নিজেকেই করতে হয়।
তবে মিউচুয়াল ফান্ড এবং নিজের প্রয়োজনের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকলে এই পথে বিনিয়োগ করাই শ্রেয় কারণ এক্ষেত্রে ওই চার্জের বোঝা কম হওয়ায় লং টার্মে বেশ খানিকটা অতিরিক্ত লাভ হয়।
এক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিবিধ চ্যানেল
পছন্দের মাধ্যম বেছে নেওয়ার পর তিন পথে বিনিয়োগ করা যেতে পারে…
1. অফলাইনেঃ
চিরাচরিত উপায় অফলাইনে যেকোনো ডিস্ট্রিবিউটর, আরআইএ, আরটিএ বা ফান্ড হাউসের অফিসে গিয়ে কিংবা তাদের এজেন্টের সাথে কথা বলে ফর্ম ফিলাপ করে, কেওয়াইসি সম্পূর্ণ করে ও চেক সাবমিট করে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
2. অনলাইনে ওয়েবসাইটে গিয়েঃ
সমস্ত ফান্ড হাউসের অনলাইন পোর্টাল আছে। এছাড়া বেশিরভাগ বড় বড় ডিস্ট্রিবিউটর, আরআইএ এবং আরটিএ-র ও নিজস্ব ওয়েবসাইট থাকে যেখানে ভিজিট করে অনলাইনে অ্যাপ্লাই ও ই-কেওয়াইসির মাধ্যমে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা যায়। অনলাইনে অ্যাপ্লিকেশন করার সময় টাকা ট্রান্সফারও যেমন অনলাইনেই করা যায় তেমনি আবার এর আরো একটা সুবিধা হচ্ছে অনলাইনে ওদের ওয়েবসাইটে গিয়ে খুব সহজেই নিজের পুরো পোর্টফোলিও দেখতে বা ট্র্যাক করতে সুবিধা হয়। এছাড়া রিডিম করার প্রয়োজন পড়লেও সহজেই সেটা করা যায়।
3. অ্যাপ ব্যবহার করেঃ
ওয়েবসাইট এর মতই আজকের এই স্মার্টফোনের যুগে ডিস্ট্রিবিউটর, ফান্ড হাউস বা আরটিএ-র অ্যাপের মাধ্যমেও এতে বিনিয়োগ করা যায়। এধরণের কয়েকটা জনপ্রিয় অ্যাপ হল,
- জিরোধা কয়েন
- গ্রো
- পেটিএম মানি
- মাই ক্যামস
- ইটি মানি
- এসবিআই মিউচুয়াল ফান্ড
- ফিসডম
- অ্যাঞ্জেল বি
- কুভেরা
ইত্যাদি।
বিনিয়োগের পুনরাবৃত্তির ওপর নির্ভর করে দুই ভাবে বিনিয়োগ
নিজের লক্ষ্য ও প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগের মাধ্যম ও ফান্ড বেছে নেওয়ার পর আপনার মূলধনের যোগান অনুযায়ী বিনিয়োগের পুনরাবৃত্তির উপর নির্ভর করে আপনি দুই ভাবে বিনিয়োগ করতে পারেন…
1. এককালীনঃ
ব্যাংকের ফিক্স ডিপোজিট করার মত বিনিয়োগের প্রথমেই এককালীন থোক টাকা বিনিয়োগ করা যায়।
2. এসআইপি-র মাধ্যমেঃ
আবার ব্যাংকে রেকারিং ডিপোজিট করার মত নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করার জন্য এসআইপি বা সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানের মাধ্যমেও বিনিয়োগ করা যেতে পারে।
শেষ কথা
এতক্ষণে আশা করি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের ব্যাপারে অনেকটা ধারণা তৈরি হয়েছে। এরপর আপনি কোন ফান্ড হাউসের কোন ফান্ডে, কোন পথে, কিভাবে, কতটা বিনিয়োগ করবেন সেই সিদ্ধান্তটা একান্তই আপনার যেটা আপনাকেই নিতে হবে আপনার পরিস্থিতির ওপর বিচার করে।
মিউচুয়াল ফান্ডের অনেকটা অংশই শেয়ার বাজার ও ইকুইটি সম্পর্কিত। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের অন্যান্য বিষয়ে জানতে এই ব্লগের শেয়ার বাজার বিভাগটা ঘেঁটে দেখতে পারেন।
আর মিউচুয়াল ফান্ডের সাথে সম্পর্কিত বিবিধ অচেনা টার্ম বা পরিভাষার বিষয়ে এই আর্টিকেলে জানতে পারবেন।
* সূত্রঃ এএফএমআই ইন্ডিয়া