শেয়ার বাজারের উপর খবরের প্রভাব কিভাবে ও কতটা পড়ে?

3.8/5 - (5 জন রেটিং করেছেন)

কম সময়ের বিচারে শেয়ারের দামের মুহুর্মুহু ওঠানামার পেছনে দায়ী বিবিধ কারণের মধ্যে একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে বিশেষ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশ্যে আসা বিশেষ কিছু খবর। বাজার সংক্রান্ত বিবিধ ক্ষেত্রের পাঁচমিশালী খবর প্রতিদিনই আমাদের সামনে আসে। আর তার মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বা অপ্রত্যাশিত খবরের প্রভাবে কিছু কিছু শেয়ারের দাম বা অনেকসময় সামগ্রিকভাবে বাজারের সূচক উপরে উঠতে বা নিচে নামতে দেখা যায়।

কোন কোন ধরনের খবর শেয়ারের দামের উপর কিভাবে, কেন ও কতটা প্রভাব ফেলে সেটাই এই নিবন্ধের আলোচনা করব।

সূচীপত্র দেখান

খবর, আমাদের জীবন আর বাজার

একদিকে টিভিতে অগন্তি ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল ও প্রতিদিনের খবরের কাগজ, অন্যদিকে ইন্টারনেটের বিবিধ ওয়েবসাইট, ইউটিউব আর ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হাজারো খবর প্রতিদিন আমাদের মাঝে আবর্তিত হতে থাকে এবং অনেকসময় সকলের আলোচনার বিষয়বস্তুও হয়ে ওঠে। ওগুলো রাজনীতি, খেলাধুলা, বিনোদন, লাইফস্টাইল, টেকনোলজি, অর্থনীতি, অপরাধ ইত্যাদির মত বিবিধ ক্ষেত্র থেকে হয়ে থাকে।

আমাদের জীবন ও সমাজের ভালো ও খারাপ এই দুই ধরণের খবরের পজিটিভ বা নেগেটিভ প্রভাব ব্যক্তি ভেদে আলাদা আলাদাভাবে আমাদের মনের উপর তথা সামগ্রিকভাবে সমাজের উপরেও পড়ে। একইভাবে, শেয়ার বাজারে অংশগ্রহণকারী ইনভেস্টার ও ট্রেডাররাও আসলে রক্তমাংসের মানুষ হওয়ায় এই বাজার, এখানে লিস্টেড কোম্পানি এবং ইকোনমি সংক্রান্ত বিভিন্ন খবরের প্রভাব তাদের মনেও পড়ে। আর ফলস্বরূপ, তাদের সমবেত প্রতিক্রিয়ার প্রভাবটা পরোক্ষভাবে বাজারের উপরে গিয়ে বর্তায়।

শেয়ার বাজারের উপর খবরের প্রভাব

এমনিতে একটা শেয়ারের দাম বাড়া-কমা হয় সেই শেয়ারের চাহিদা এবং যোগানের উপর নির্ভর করে। যোগানের থেকে চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ে আর চাহিদার থেকে যোগান বেশি থাকলে দাম কমে। অন্যদিকে, সামগ্রিকভাবে বাজারের উত্থান-পতন নির্দেশকারী সূচকগুলো (যেমন নিফটি ৫০) যে সমস্ত শেয়ার একত্রিত তৈরি হয় সেই সমস্ত শেয়ারগুলোর দামের সম্মিলিত ওঠানামার ফলস্বরূপ ওঠানামা করে।

খবর সরাসরি শেয়ারের দামের উপর প্রভাব ফেলতে পারেনা। শেয়ারের দাম পরিবর্তিত হয় একটা খবরের পরিপ্রেক্ষিতে ইনভেস্টার-ট্রেডারদের সমবেত প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ। বাজার বা শেয়ার সম্পর্কিত বিশেষ একটা খবরের উপর ইনভেস্টারদের প্রতিক্রিয়া পজিটিভ হলে তারা লাভের আশায় আরো বেশি বেশি করে শেয়ার কিনতে উদ্যত হয়। ফলস্বরূপ যোগানের তুলনায় চাহিদা বাড়ে এবং শেয়ারের দাম চড়তে শুরু করে। আর অন্যদিকে প্রতিক্রিয়া উল্টো হলে লসের ভয়ে তারা তাদের কাছে থাকা শেয়ার বেচে দিতে চায়, এবং ফলস্বরূপ চাহিদার থেকে যোগান বেড়ে গিয়ে শেয়ারের দাম পড়ে যায়।

একই খবর, আলাদা প্রতিক্রিয়া

একটা খবর সব সময় যে সমস্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একই রকম প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে, তেমনটা কিন্তু না-ও হতে পারে। বাজার, সেক্টর বা নির্দিষ্ট কোনো শেয়ার সম্পর্কিত বিশেষ কোনো খবর অনেক সময় আলাদা আলাদা গ্রুপের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আলাদা আলাদা রকম প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।

সাধারণভাবে একটা ভালো বার্তা, যা ব্যবসার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আশাপ্রদ হয়, তা স্বাভাবিকভাবে শেয়ারের দাম বাড়ার কারণ হয়। আর একটা খারাপ সংবাদ, যা ব্যবসা চলার বা বৃদ্ধির পথে বাধা তৈরি হওয়ার অশনি সংকেত বহন করে তা স্বাভাবিকভাবেই শেয়ারের দাম কমার কারণ হয়। তবে একটা ঘটনা বা খবরের প্রভাব শেয়ারের দামের ওপর যতটা পড়ার কথা কখনও তার থেকে বেশি আর কখনও কম পড়ে। কখনও আবার একেবারে বিপরীত প্রভাবও পড়ে।

খবরের মাত্রাতিরিক্ত বা স্তিমিত প্রতিক্রিয়া

কখনও কখনও খবর যত না বড়, শেয়ারের দামের উপর তার প্রতিক্রিয়া তার থেকে অনেক বেশি হয়; আবার কখনও বিশাল ব্রেকিং নিউজ-ও শেয়ারের দামে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনা। আর এটা ভালো এবং খারাপ দুই ধরনের খবরের ক্ষেত্রেই হতে পারে।

যেমন ধরুন, দুটো কোম্পানির কোয়াটারলি আর্নিং রিপোর্টে দেখা গেল তাদের লাভ একই রকম বেড়েছে। কিন্তু এই একই ধরণের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় একটা কোম্পানির শেয়ারের দাম ৩৫% বাড়লো তো অন্যটার মোটে ৫%! এই একই ধরণের কিন্তু বিপরীত ঘটনাও দেখা যেতে পারে লাভ কমার রিপোর্ট বেরোলে। এই সবই ঘটে রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারীদের প্রতিক্রিয়ার তারতম্যের ফলস্বরূপ। 

বিপরীত প্রতিক্রিয়া

কখনো আবার আপাতভাবে একটা ভালো খবর শেয়ারের দাম বাড়ার বদলে কমে যাওয়ার কারণ হয় আর একইভাবে একটা খারাপ খবর শেয়ারের দাম বাড়ারও কারণ হয়!

এইমাত্র যে আর্নিং রিপোর্টের কথা বলছিলাম, সেই কথাতেই যদি ফিরে আসি, তাহলে দেখা যাবে কখনও আর্নিং রিপোর্টে লাভের খবরেও শেয়ারের দাম পড়ে যায় আবার অনেক সময় লসও শেয়ারের দাম বাড়ার কারণ হয়। এর আসল কারণ হচ্ছে আর্নিং রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার আগে শেয়ার সম্পর্কে বাজারের প্রত্যাশা, আগের রিপোর্টের তুলনায় বর্তমান রিপোর্টের অঙ্ক বা রিপোর্ট বের হওয়ার আগেই মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশার জন্য ইতিমধ্যেই অনেকটা দামের পরিবর্তন হয়ে যাওয়া।

আরও পড়ুনঃ  শেয়ার বাজার কি জুয়াড়িদের জায়গা?

বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের আর্নিং রিপোর্ট পেশ করার আগেই বিভিন্ন অ্যানালিস্ট ওই কোম্পানির আর্নিং সম্পর্কে তাদের প্রত্যাশা প্রকাশ করে। আর আর্নিং পজিটিভ হলেও যদি প্রত্যাশার সাথে না মেলে তখন অনেক সময় শেয়ারের দাম কমতে দেখা যায়। একইভাবে আর্নিং রিপোর্টে যদি লস ও থাকে, সেটা যদি প্রত্যাশার থেকে কম হয় বা আগেরবারের তুলনায় অনেক কম হয় তবে শেয়ারের দামের উপর ভালো প্রভাব পড়ে। 

কারো সর্বনাশ তো কারো পৌষ মাস!

কখনো কখনো আবার কিছু কিছু খবর যেটা কিছু শেয়ারের জন্য খারাপ হয় সেটা কিছু শেয়ারের জন্য ভালোও হয়।

এই যেমন ধরুন করোনা মহামারির সময় যখন লকডাউন হয় তখন এয়ারলাইন্স, হোটেল ও ট্র্যাভেল সম্পর্কিত শেয়ারের ওপর ভীষণভাবে নেগেটিভ প্রভাব পড়ে। কিন্তু এই একই ঘটনার প্রভাবে (প্রাথমিক শকটা কাটিয়ে ওঠার পর) ই-কমার্স, স্বাস্থ্য, মিডিয়া, ফ্রিল্যান্সিং ও টেকনোলজির বিবিধ কোম্পানির শেয়ারের দামে দারুন পজিটিভ ফল হতে দেখা যায়।

খবরের ধরণ

ঠিক যেমনভাবে আমরা সবাই সব ধরনের সংবাদের খোঁজ রাখতে পছন্দ করিনা, বা সব খবর আমাদের মনে ধরে না, তেমনি প্রতিদিন ঘটে চলা বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রটা সব খবর শেয়ার বাজারের উপরেও প্রভাব ফেলে না। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রের বিশেষ কিছু খবরই শেয়ার বাজারকে প্রভাবিত করে।

যে ধরণের খবরগুলো শেয়ার বাজারের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সেগুলোকে প্রযোজ্য ক্ষেত্রের পরিধির উপর নির্ভর করে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন,

পুরো বাজারকে প্রভাবিত করে এমন

কিছু কিছু খবর ভালো-খারাপ, ছোটো-বড় নির্বিশেষে সব ধরনের শেয়ার তথা পুরো বাজারের উপর প্রভাব ফেলে। এগুলো দেশের ভেতরের বা আন্তর্জাতিক স্তরের হতে পারে।

দেশের অভ্যন্তরীণ

দেশের ভেতরের বিশেষ রাজনৈতিক ঘটনাবলী, ভোটের প্রত্যাশিত বা অপ্রত্যাশিত ফলাফল, বড় কোনো পলিসির বাস্তবায়ন বা পরিবর্তন, জিডিপি নম্বর, মুদ্রাস্ফীতি বা সুদের হার, বড় কোনো কেলেঙ্কারি ইত্যাদি সম্পর্কিত খবরের প্রভাব অনেক সময় সব ধরনের শেয়ারের উপরেই পড়ে। কারন, এই ধরণের বড় বড় ঘটনার প্রভাব কম-বেশি সব ধরণের ব্যবসার উপরই পড়ে। এমনকি এগুলোর সাথে কোনো শেয়ারের সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও যখন বেশীরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম হু হু করে কমে (বা বাড়ে) তখন সেই স্রোতে ঐ সম্পর্কহীন শেয়ারগুলোও ভেসে যায়!

শেয়ার বাজারের ইতিহাসে দেশের অভ্যন্তরীণ খবরের প্রভাবে পুরো বাজারের বড়সড় উত্থান পতন সম্পর্কিত কয়েকটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলঃ

  • ১৯৯২ সালে হর্ষদ মেহতা কেলেঙ্কারির সংবাদ যখন প্রকাশ্যে আসে তখন সেই সময়টায় পুরো বাজার ৫০% পড়ে যায়। 
  • ২০১৬ সালে ডি-মনিটাইজেশনের বার্তা প্রকাশ্যে আসার দিনে নিফটি ৬% এরও বেশি পড়ে যায়।

— এই ধরনের উদাহরণ ভুরি ভুরি দেওয়া যায়। মোদ্দা কথা হচ্ছে, যত বড় ঘটনা ঘটে তার তত বড় হেডলাইন তৈরি হয় আর বাজারের ওপর তার প্রতিক্রিয়াও তত বেশি হয়। 

আন্তর্জাতিক

যদি কখনো পৃথিবীর দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে প্রকৃত যুদ্ধ বা ট্রেড ওয়ার শুরু হয়, পৃথিবী কোনো মহামারীর প্রকোপে পড়ে, প্রাকৃতিক বড় কোনো বিপর্যয় তৈরি হয় কিনবা পৃথিবীর সবথেকে উন্নত দেশগুলোয় (যেমন আমেরিকায়) যেকোনো রকম অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয় তবে সেই ধরণের খবর প্রকাশ্যে আসার পর তার নেগেটিভ প্রভাব সব দেশের শেয়ার বাজারের উপরই পড়ে।

আবার যখন এই ধরণের খারাপ পরিস্থিতিগুলো শেষ হয় বা বেশিরভাগ বাইরের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বিষয়ে আশাব্যাঞ্জক খবর শোনা যায় তখন তার প্রভাব দেশের শেয়ার বাজারেও পড়ে। 

উদাহরণঃ

  • ২০২০ সালের করোনা অতিমারির দুঃসংবাদ যখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন সারা পৃথিবীর সমস্ত দেশের শেয়ারবাজারে বিশাল বড় একটা ঝটকা লেগেছিল। ওই সময়ে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে নিফটি প্রায় ৪০% পড়ে গিয়েছিল।
  • ২০১৭-১৮ সালে পৃথিবীব্যাপী আর্থিক সংকটের খবরের প্রভাব দেশীয় শেয়ার বাজারের উপর এমনভাবে পড়েছিল যে এক বছরে বাজার ৬০% পড়ে গিয়েছিল।

— এই ধরণের বড় বড় খবর ছাড়াও অনেক সময় সুদ বৃদ্ধি/ কমা, যুগান্তকারী কোনো আবিস্কার, জব ডেটা, তেলের দর ইত্যাদি সম্পর্কিত খবরের প্রভাবে বাজারে ছোটোখাটো উত্থান-পতন হতে দেখা যায়। 

বিশেষ কোনো সেক্টরকে প্রভাবিত করে এমন

কখনো কখনো এক একটা খবর বিশেষ বিশেষ সেক্টরের ওপর তথা সেই সেক্টরের বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দামের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। 

যেমন, ধরুন কোনো এক বছরের বাজেটে ঘোষণা হলো যে প্রতিরক্ষা খাতে আগের বছরের থেকে ডবল খরচের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হবে। তো এই ঘোষণার প্রভাবে দেখা যাবে ডিফেন্স সেক্টরের অনেক কোম্পানির শেয়ারের দামই তরতর করে চড়তে শুরু করবে। আদৌ ভবিষ্যতে কোন কোম্পানি টেন্ডার পাবে বা ঘোষণা কতটা কার্যকর হবে সেই ব্যাপারে পরিস্কার তথ্য না থাকলেও এই একটা খবরের প্রভাবেই কম সময়ের বিচারে এই সেক্টরের বিবিধ শেয়ারের উপর ভীষণভাবে প্রভাব পড়তে দেখা যাবে।

আরও পড়ুনঃ  শেয়ার বাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকি কমানোর 10 উপায়। #3 সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ

আলাদা আলাদা শেয়ারকে প্রভাবিত করে এমন

অনেক খবর হয় বিশেষ একটা কোম্পানি স্পেসিফিক। আর এগুলোর প্রভাব সাধারনত ঐ একটা কোম্পানির শেয়ারের দামের উপরই পড়ে। এগুলো যে যে ধরণের হয় তা হল,

আর্নিং রিপোর্ট

এ ব্যাপারে কিছুক্ষণ আগেই বলেছি। কোম্পানির প্রকাশ করা কোয়াটারলি ও অ্যানুয়াল আর্নিং রিপোর্টের খবর যদি আগের বছরের থেকে, প্রত্যাশার থেকে বা একই সেক্টরের অন্যান্য কোম্পানির থেকে ভালো হয় তবে শেয়ারের দাম বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় আর অন্যথায় দাম কমার সম্ভাবনা তৈরি হয়। 

অ্যাকুইজিশন ও মার্জার

একটা কোম্পানির আরেক কোম্পানিকে অধিগ্রহণ বা অ্যাকুইজিশন কিংবা দুই কোম্পানির মার্জারের খবর অনেক সময় ওই দুই কোম্পানির শেয়ারের দামের ওপর ভীষণভাবে পজিটিভ প্রভাব ফেলে। কারণ, সাধারণত এই অ্যাকুইজিশন বা মার্জারের ফলে ব্যবসা আরো বাড়ার বা আরও বেশি মার্কেট শেয়ার পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

অনেক সময় এই ধরণের ঘটনা প্রকৃতপক্ষে বাস্তবায়িত না হলেও শুধুমাত্র গুজবই শেয়ারের দামের উপর প্রভাব বিস্তার করে দেয়। আর বড় কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে এই জিনিসটা হলে কখনও কখনও এর নেগেটিভ প্রভাব ওই সেক্টরের অন্য কোম্পানির উপরেও পড়ে। 

বিশেষ চুক্তি বা পার্টনারশিপ

দুই কোম্পানির বড় কোনো চুক্তি হওয়া বা কোনো কারণে প্রস্তাবিত চুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়ার খবর শেয়ারের দামের উপর যথাক্রমে পজিটিভ বা নেগেটিভ প্রভাব ফেলে। কারণ, বড় চুক্তি মানেই ব্যবসা ও লাভ বাড়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হওয়া।

তবে অনেক সময় অনেক কোম্পানি বড়াও করে কিছু কিছু চুক্তির ঘোষণা করে চর্চায় থাকার জন্য। আর সেই ধরনের চুক্তির জন্য কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল বা ভ্যালুতে বড় কোনো পরিবর্তনের খুব একটা সম্ভাবনা থাকে না। ফলে খবরের প্রাথমিক রিঅ্যাকশনে শেয়ারের দামের পরিবর্তন হলেও তা কিছুদিনের মধ্যেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। 

বড় অর্ডার

উপরের দুই ধরনের ঘটনার মতই বড় অর্ডার পাওয়ার খবরও অনেক সময় শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দেয়।

নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ

বড় কোনো কোম্পানি যুগান্তকারী বা ভীষণ জনপ্রিয় নতুন কোনো প্রোডাক্ট লঞ্চ করার সময় সেই প্রোডাক্টের সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে ব্যবসা ও লাভ তড়িৎগতিতে বাড়বে এই আশায় বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি বেশি করে ঐ শেয়ার কিনতে শুরু করে এবং ফলস্বরূপ শেয়ারের দাম বাড়তে দেখা যায়। 

উদাহরণস্বরূপ, আইফোনের নতুন মডেল লঞ্চের সময় এই ধরনের প্রভাব দেখা যায় অ্যাপেল কোম্পানির শেয়ারে।

রেটিং

বিভিন্ন রেটিং এজেন্সি সময়ে সময়ে বিভিন্ন কোম্পানির ব্যবসার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে ঐ শেয়ারের রেটিং প্রকাশ করে। বড় কোনো রেটিং এজেন্সি দ্বারা কোনো শেয়ারের রেটিং আপগ্রেডের সুসংবাদ প্রকাশ্যে এলে যেমন সেই শেয়ারের দাম বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, ঠিক তেমনি রেটিং ডাউনগ্রেডের দুঃসংবাদ শেয়ারের দাম কমারও কারণ হয়। 

ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টারদের বেচাকেনা

হাই নেট ইন্ডিভিজুয়াল ইনভেস্টার কিংবা ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টারদের কোনো কোম্পানির শেয়ার বাল্কে কেনা বা বেচার খবর অনেক সময় শেয়ারের দামে বড় প্রভাব ফেলে। 

কোম্পানির পরিচালনাগত বা নীতিগত সমস্যা

অনেক কোম্পানিরই ভিতরে ভিতরে কিছু কিছু দু’নম্বরী কাজকর্ম চলে বা হিসেবের গরমিল করতে দেখা যায়। ট্যাক্সে ফাঁকি, অ্যানুয়াল রিপোর্টে কাটা-ছেঁড়া, তথ্য গোপন, ব্যবসা বৃদ্ধিতে অনৈতিক উপায় অনুসরণ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের পরিচালনাগত বা নীতিগত সমস্যাগুলো যখন কোনো কারণে প্রকাশ্যে আসে তখন সেটা ভীষণ বড় খবর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে আর শেয়ারের দামে বড় পতনের কারণ হয়। 

মামলা

কোম্পানির ভিতরে প্রকৃত সমস্যা থাকুক বা না থাকুক, যেকোনো কারণে যদি কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে কেস-মোকদ্দমা হয়, তবে সেই খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্র তার বিরূপ ফল ও কখনো কখনো শেয়ারের দামেও পড়ে। 

অপ্রত্যাশিত ঘটনা

কিছু কিছু ঘটনা আগে থেকে কখনোই পূর্বানুমান করা যায় না। কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোডাক্টে কোনো সমস্যা ধরা পড়া এবং তা বাজার থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হওয়া, সরকারের হঠাৎ কোনো পলিসির পরিবর্তন করা, ব্যবসা ক্ষেত্রে হঠাৎ নতুন ও বড় কোনো প্রতিযোগীর আবির্ভাব হওয়া ইত্যাদির মত অপ্রত্যাশিত ঘটনার খবর অনেক সময় বিনিয়োগকারীদের মনের ওপর প্রভাব ফেলে শেয়ারের দামে হেরফের করে দেয়। 

গুজব

সত্যি হোক বা মিথ্যে হোক, যেকোনো কোম্পানি সম্পর্কে কোনো একটা গুজব যখন রটে তখন তা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। গুজবের শুরু কে বা কেন করেছিল সেটা ভাবার বা খুঁজে পাওয়ার আগেই তার ফল কিন্তু ঐ কোম্পানির শেয়ারের দামের উপর ভীষণভাবে পড়ে যায়।

এই গুজব যেকোনো বিষয়ের উপর হতে পারে। অ্যাকুইজিশন বা মার্জারের মতো ভালো বিষয়ের গুজব হলে তার প্রভাব যেমন শেয়ারের উপর পজিটিভ ভাবে পড়ে তেমনি কোম্পানির ভেতরে কোনো সমস্যার গল্প কানাঘুষোর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তার প্রভাব হয় উল্টো। তবে গুজব যদি সত্যি না হয় সাধারণত খানিকটা সময়ের মধ্যেই তার প্রভাব কেটে যেতে দেখা যায়।

খবর আর ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টার বনাম সাধারণ রিটেল ইনভেস্টার-ট্রেডার

এতক্ষণের আলোচনায় এটা পরিষ্কার যে বিবিধ খবর সময় সময়ে কিছুক্ষণের জন্য বা কিছুটা হলেও শেয়ারের দামের উপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু এই বিষয়টা কাজে লাগিয়ে কিছু লাভ পাওয়ার পরিকল্পনা করতে গেলে খবর প্রকাশ পাওয়ার আগেই ঘটনাটা সম্পর্কে জানার বা অন্তত আভাস পাওয়ার দরকার পড়ে। আর সেটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই অসম্ভব হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিন্তু সংবাদ প্রচার হওয়ার আগে বা সবার আগে জানতে পারাটা একেবারেই অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে না। তবে সেই সুযোগ বা ক্ষমতা কেবলমাত্র প্রভাবশালী কিছু বড় ইনভেস্টার এবং ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টারদের কাছেই থাকে।

আরও পড়ুনঃ  শেয়ার ট্রেডিং-এর সেরা 7 ইন্ডিকেটর। টেকনিক্যাল অ্যানালিসিসের ব্রম্ভাস্ত্র

কিন্তু আপনার আমার মত সাধারণ রিটেল ইনভেস্টার বা ট্রেডারদের জন্য এগুলো শুধুমাত্র চোখের সামনে ঘটা একটা ঘটনা হয়েই রয়ে যায়। খবরের প্রভাবে শেয়ারের দামে যা পরিবর্তন হয় সেটা ইতিমধ্যে ঘটার পরেই বিষয়টা আমাদের নজরে আসে। তাই বাজারে প্রতিমুহূর্তে হাজার একটা খবর প্রকাশ পেলেও তা থেকে লাভ করার সুযোগ সাধারণ রিটেল ইনভেস্টার-ট্রেডারদের খুব একটা থাকে না। তবে লাভের সুযোগ না থাকলেও, পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে এর নেগেটিভ প্রভাব থেকে পোর্টফোলিওকে বাঁচানোর সুযোগ সবার হাতেই থাকে।

নিজের পোর্টফোলিওতে খবরের প্রভাব কিভাবে হ্রাস করা যাবে 

আমাদের চারপাশে বা পৃথিবীতে আগামীতে কি ঘটবে, একটা কোম্পানির ভবিষ্যৎ কী হবে, শেয়ারের দাম চড়বে কি পড়বে ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতাই আমাদের হাতে নেই। আমাদের হাতে যেটা আছে সেটা হচ্ছে প্রতিদিন ঘটে চলা বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আবেগ তথা প্রতিক্রিয়াটা নিয়ন্ত্রন করা। আর শেয়ার বাজারে বিনিয়োগে সফলতার মূলমন্ত্র এটাই। বিভিন্ন রকম খবরের নেগেটিভ প্রভাব থেকে নিজের পোর্টফোলিওকে বাঁচাতে নীচের কাজগুলো করা যেতে পারে,

ধীর স্থির থাকতে হবে, আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং কোলাহল উপেক্ষা করতে হবে

আজকের দিনে ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া আর ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেলের বকবকানি থেকে চারপাশে কখন কি ঘটে চলেছে সে ব্যাপারে খুব সহজেই ওয়াকিবহাল থাকা যায়। তবে এত খবর ও এত তথ্য খুব সহজেই আমাদের মনকে ওভারলোড করে দিতে পারে। প্রত্যেকটা মুহূর্তে প্রতিটা খবরের উপর নজর রাখা আবেগের দিক থেকে মোটেও ভালো কাজ নয়। যত বেশি বেশি খবর আমাদের মাথায় ঢোকে তত বেশি বেশি তা আমাদের আবেগের উপর প্রভাব ফেলে।

তবে চারপাশের ঘটে চলা ঘটনাবলী পুরোপুরি উপেক্ষা করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিনিয়োগের যাত্রায় সবথেকে বেশি লাভের উদ্দেশ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সঠিক তথ্য জানাটাও জরুরী। তবে কোন জিনিসটা পড়া বা দেখা উচিৎ হবে এবং কত ঘন ঘন সেটা করা ঠিক হবে সে ব্যাপারে অবশ্যই খেয়াল রাখা প্রয়োজন। 

ধীরস্থির থাকতে চাওয়ার থেকে প্রকৃতপক্ষে থাকাটা খুবই কঠিন একটা কাজ। তাছাড়া মিডিয়া এক একটা ছোট ছোট ঘটনাকে এত বেশি মশলাদার ও অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে যে সেগুলো দেখার পর স্থির থাকাটা খুবই কঠিন হয়ে যায়। তাই নিজের পোর্টফোলিও এবং বিনিয়োগের পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে যে জিনিসগুলো সম্পর্কে জানার বা ওয়াকিবহাল থাকা প্রয়োজন সেগুলো বাদে অন্যান্য বিষয়গুলোকে যতটা উপেক্ষা করা যায় ততই মঙ্গল।

পোর্টফোলিও ডাইভারসিফাই করতে হবে

বিনিয়োগের পরিকল্পনার একটা প্রধান উপাদান হচ্ছে ডাইভারসিফিকেশন। বাজার সংক্রান্ত সমস্ত রকম ঝুঁকির মতোই খবরের প্রভাব থেকে পোর্টফোলিওকে বাঁচানোর একটা ভালো দাওয়াই হল ডাইভারসিফাই করা।

যেমন ধরুন, খবর যদি একটা কোনো কোম্পানি সম্পর্কে হয় তবে একাধিক শেয়ার পোর্টফোলিতে থাকলে ওই একটা শেয়ারের দামের উত্থান পতন থেকে পোর্টফোলিওকে বাঁচানো যায়। আবার বিভিন্ন সেক্টর থেকে শেয়ার পোর্টফোলিওতে থাকলে একটা সেক্টরের ওপর প্রভাব ফেলে এই রকম বার্তা পুরো পোর্টফোলিওর ভ্যালুর উপর খুব একটা প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। আর পুরো বাজারকে প্রভাবিত করে এমন সংবাদ থেকে পোর্টফলিওকে বাঁচায় গোল্ড ও বন্ড। 

লং টার্মের লক্ষ্যের কথা ভুলে গেলে চলবে না

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে ভালো রিটার্ন পাওয়ার একটা শর্ত হচ্ছে লং টার্মের জন্য বিনিয়োগ করা। কারণ, শর্ট টার্মে ছোটখাটো খবর যেমন আসতে থাকবে তেমনি ছোটখাটো ঘটনাও সবসময়ই ঘটতে থাকবে। আর তার ফলে শেয়ারের দামের ছোটখাটো উত্থান পতন চলতেই থাকবে। কিন্তু ভালো শেয়ার বেছে নিয়ে এবং তাতে বিনিয়োগ করে লম্বা সময়ের জন্য অপেক্ষা করলে স্বল্পসময়ের এইসব ছোটখাটো উত্থান পতন গুলো ন্যাস্যাত হয়ে গিয়ে লম্বা সময়ের বিচারে একটা ভালো রিটার্ন ঠিকই চলে আসবে।

তাই লং টার্ম বিনিয়োগের লক্ষ্য নিয়ে শেয়ার বাছাইয়ের পর বিনিয়োগ করা হয়ে গেলে ওই লম্বা সময়ের লক্ষ্যটা স্থির রেখে বিবিধ খবরের প্রভাবে হওয়া ছোট ছোট উত্থান-পতন গুলোকে উপেক্ষা করতে হবে। আর তা হলেই বিনিয়োগের প্রকৃত রিটার্ন পাওয়া যাবে। 

শেষ কথা

সবশেষে বলব বাজারে লম্বা সময় ধরে টিকে থাকলে এবং অ্যাকশনের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করলে কোনটা বাজারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ খবর আর কোনটা নয় সে বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যাবে। আর সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলেই একজন ভালো ইনভেস্টার বা ট্রেডার হয়ে ওঠা যাবে।

মন্তব্য করুন