বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস কিভাবে ব্যবহার করে?

5/5 - (2 জন রেটিং করেছেন)

আমাদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে শেয়ার বাজারে ট্রেডিং-এর ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস করতে হয় আর অন্যদিকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কাজে আসে ফান্ডামেন্টাল অ্যানালাইসিস। ট্রেডাররা ট্রেড করার সময় তাদের এন্ট্রি ও এক্সিট পরিকল্পনা করতে যেখানে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের সাহায্য নেয়, সেখানে কোনো কোম্পানি ভালো না খারাপ আর ভালো হলে কতটা ভালো সেটা বুঝতে বিনিয়োগকারীদের ফান্ডামেন্টাল অ্যানালাইসিসের রাস্তা ধরতে হয়।

কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে আরও ভালো ফল পেতে হলে প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে ফান্ডামেন্টালের পাশাপাশি টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসেরও ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে। আর এই নিবন্ধে ঐ ব্যবহার-প্রণালীর কথাই জানতে পারবেন…

সূচীপত্র দেখান

দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের প্রয়োজন পড়ে কেন?

দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের লজিক

শেয়ার বাজারে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য সবথেকে প্রধান শর্ত হচ্ছে সেরার সেরা কোম্পানি খুঁজে বের করা এবং সেখানে বিনিয়োগ করে লাভ পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর কিংবা অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করা। তাই এক্ষেত্রে প্রধান ফোকাস শেয়ার কেনার উপরই থাকে এবং বেচার বিষয়টা গৌণ হয়।

“চিরতরে হোল্ড করাই আমাদের পছন্দ।”

-ওয়ারেন বাফেট

শেয়ারের দামের বাড়া-কমা

ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম লম্বা সময়ের বিচারে বাড়ার বিষয়টা বেশীরভাগক্ষেত্রে সত্যি হলেও বৃদ্ধিটা কিন্তু সোজা লাইন ধরে বা নিয়মমাফিক হয় না। বরং এটা সাধারণত সাইক্লিক্যাল হয়। মানে সংক্ষিপ্ত সময়ের বিচারে দাম একবার বাড়ে তো পরক্ষনেই কমে। এবং এই পরিবর্তনটা কখনও হয় ধীর গতিতে তো কখনও ঝড়ের বেগে।

চাহিদা ও যোগান

দাম উপর-নিচ হওয়ার ব্যাপারটা ঘটে বাজারে শেয়ারের চাহিদা এবং যোগানের ক্রম-পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে। কোনো শেয়ারের চাহিদা যখন যোগানের থেকে মাত্রাতিরিক্ত বেশি হয় তখন বিনিয়োগকারীরা সেটার প্রকৃত যা দাম হওয়া উচিত তার থেকে অনেক বেশি দামে কিনতে রাজি হয়ে যায়, ফলে সেটার দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কিন্তু এধরণের চাহিদা চিরস্থায়ী হয়না বা হতে পারেনা। চাহিদা জিনিসটাই এমন যে একবার বাড়ে তো একবার কমে। চাহিদা যখন যোগানের তুলনায় কমে যায় তখন সবাই যে যা দাম পায় তাতেই বেচে দিতে চায় ফলে শেয়ারের দাম পড়ে যায়।

যখন তখন কেনার সমস্যা

শেয়ার যতই ভালো হোক, যখন সেটার চাহিদা তথা দাম অস্বাভাবিক রকম বেশি থাকে তখন যদি কেনা হয় এবং কেনার পরই যদি সাইক্লিক্যাল নীতিতে চাহিদা পড়ে যায় বা দাম কমার পর্যায় শুরু হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে পজিটিভ রিটার্ন পেতে অনেক বেশী সময় লেগে যেতে পারে।

বিনিয়োগের উপযুক্ত সময়

কিংবদন্তি বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট বাবু বলেন, ‘সবাই যখন লোভী তখন ভীত হও আর সবাই ভীত হলে লোভী হও।’ মানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশি ভালো ফল পেতে চাহিদা বা দাম যখন লাগামছাড়া সেসময়ের পরিবর্তে চাহিদা তথা দাম যখন কমের দিকে থাকে তখনই শেয়ার কেনা উচিৎ। এতে একদিকে যেমন বিনিয়োগের ঝুঁকিটা কমিয়ে আনা যায় তেমন কম সময়ের মধ্যে বেশি রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনাটাও বাড়ে।

— এই চাহিদা ও যোগানের ওঠাপড়ার নকশা বানাতে বা কখন চাহিদা কম সেটা বুঝে নিয়ে বিনিয়োগের উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করতে দরকার পড়ে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের।

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস আসলে কী?

শেয়ার বাজারে যা কিছুই করতে যাওয়া হোক না কেন, কিছু ঝুঁকি বা রিস্ক তো থাকেই। টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস শেয়ারের দামের পরিবর্তন সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য উন্মোচন করে যেগুলোর সাহায্যে সেই ঝুঁকি কিছুটা লাঘব করা যায় বা গণনালব্ধ ঝুঁকি (ক্যালকুলেটেড রিস্ক) নিতে সুবিধে হয়।

শেয়ার বাজার যতক্ষণ খোলা থাকে ততক্ষন লিস্টেড শেয়ার গুলো কেনা-বেচা করতে ক্রেতা ও বিক্রেতারা অনবরত অর্ডার প্লেস করতে থাকে। কেনাবেচার এই লড়াইতে যখন ক্রেতাদের দল ভারী হয়, মানে চাহিদা বাড়ে, তখন শেয়ারের দাম বাড়ে আর উল্টোটা হলে, মানে বিক্রেতারা সংখ্যায় বেশি হলে চাহিদার থেকে জোগান বেশি হয়, ফলে দাম কমে। টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস হচ্ছে এই ক্রেতা (চাহিদা) ও বিক্রেতার (যোগান) তীব্র লড়াইয়ের চাক্ষুষ উপস্থাপনা (ভিজুয়াল রিপ্রেজেন্টেশন)।

কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল্‌স ও এর পাশাপাশি বাজার সক্রান্ত হাজারো ঘটনা এবং তার সাথে লক্ষ্য লক্ষ্য ক্রেতা ও বিক্রেতার আবেগ মিশে গিয়ে চাহিদা ও যোগানের বিশেষ এক ঢেউ তৈরি করে। ঐ ঢেউ দৃশ্যমান হয় শেয়ারের দামের পরিবর্তনের প্যাটার্নে। শেয়ারের দামের চার্টে ঐ প্যাটার্নগুলো ধরা পড়ে। আর চার্ট দেখে ঐ সমস্ত প্যাটার্ন গুলো শনাক্ত করার মাধ্যমে শেয়ারের দাম তথা বাজারের গতিবিধি আন্দাজ করার ব্যবস্থাপনাই হল টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস।

আরও পড়ুনঃ  শেয়ার বাজারের ট্রেডিং কোর্সের বাস্তব সত্যি! খরচের আগে জেনে নিন।

এক্ষেত্রে চার্টিং প্রধানত ২ ধরণের তথ্যের ইনপুটের উপর নির্ভর করে, যথাঃ

  • শেয়ারের পূর্বকালীন দাম (হিস্টোরিকাল প্রাইসেস) এবং
  • ভলিউম বা ট্রেডের সংখ্যা।

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের প্রধান উপকরণ

এই অ্যানালাইসিসের প্রধান উপকরণগুলো হল,

#১ চার্ট

নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে শেয়ারের পূর্বকালীন দামগুলোকে বিভিন্নভাবে প্লট করে বিভিন্নধরনের চার্ট পাওয়া যায়। ক্যান্ডেলস্টিক চার্ট সব থেকে বেশি প্রচলিত। এছাড়াও লাইন চার্ট, বার চার্ট ও আরো অন্যান্য ধরনের চার্ট-ও হয়।

#২ বিবিধ ইন্ডিকেটর

পূর্বে উল্লিখিত চার্টিং ইনপুটের তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি অনুসন্ধানমূলক বা প্যাটার্ন ভিত্তিক বিভিন্ন সংকেত-ই হল ইন্ডিকেটর। এগুলো অনেক ধরণের ও অনেক রকমের হয়। কিছু ইন্ডিকেটর চার্টের উপরেই ওভারলে হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কিছু আবার প্রধান চার্টের সাথে সংযোজন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এগুলো একক ভাবে বা কতকগুলো ইন্ডিকেটর মিলিতভাবে এই অ্যানালাইসিস করতে ভীষণভাবে সাহায্য করে। কয়েকটা বহুল ব্যবহৃত ইন্ডিকেটর হলো,

মুভিং অ্যাভারেজ – এটা হল পূর্বকালীন দামের গড়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি একটা বক্ররেখা। সিম্পল (এসএমএ) এবং এক্সপোনিয়েন্সিয়াল (ইএমএ) – এই দুই ধরণের মুভিং অ্যাভারেজ সব থেকে বেশি ব্যবহৃত হয়। ইএমএ সাম্প্রতিক দামের উপর বেশি জোর দেয়।

আর এস আই – এটার পুরো কথা রিলেটিভ স্ট্রেন্থ ইনডেক্স। শেয়ারের শক্তি বা দুর্বলতা মাপতে এই ইন্ডিকেটর ব্যবহার করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ে একটা শেয়ারের দাম কত বেশি বা কম গতিবেগে বাড়ে বা কমে সেটা এই ইন্ডিকেটর থেকে বোঝা যায়।

ভলিউম – নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেডের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে তৈরি কলাম চার্টই হল ভলিউম ইন্ডিকেটর।

সাপোর্ট ও রেজিস্ট্যান্স কী?

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে বিনিয়োগে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাপোর্ট ও রেজিস্ট্যান্সের ধারণাটা খুবই জরুরী।

ডাউন ট্রেন্ডের সময় যোগানের থেকে চাহিদা কম থাকে তাই দাম ক্রমশ পড়তে থাকে। আবার দাম যত পড়তে থাকে কম দামে সেই শেয়ার কেনার জন্য অপেক্ষারত-দের কাছে পড়ন্ত দাম ক্রমশ আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে পুনরায় তারা সেই শেয়ার কিনতে উদ্যত হয়। ফলে চাহিদা আবার ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। একটা জায়গায় গিয়ে যোগান আর চাহিদা সমান সমান হয়ে যায়। এবং তখন দামের পতন থমকে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। এই জায়গাটাই সাপোর্ট। সাধারণত এই পয়েন্টে চাহিদা যোগানকে ছাপিয়ে যেতে শুরু করে, দাম উল্টোদিকে ঘুরে যায় এবং চার্টে একটা নিম্নমুখী চূড়া তৈরি হয়।

রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে সাপোর্টের ঠিক উল্টো। আপ ট্রেন্ডের সময় যোগানের থেকে চাহিদা বেশি থাকে তাই দাম ক্রমশ বাড়তে থাকে। আবার দাম বাড়ার সাথে সাথে বর্তমান শেয়ারহোল্ডাররা বাড়ন্ত দামে শেয়ার বেচে লাভ পকেটজাত করার লোভ চরিতার্থ করতে এবং পাছে আবার দাম কমে যায় সেই ভয়ে ক্রমশ সেই শেয়ার বেচে দিয়ে প্রফিট বুক করতে উদ্যত হয়। ফলে যোগান আবার ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। একটা জায়গায় গিয়ে চাহিদা আর যোগান সমান সমান হয়ে যায়। এবং তখন দামের বৃদ্ধি থমকে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। এই জায়গাটাই রেজিস্ট্যান্স। সাধারণত এই পয়েন্টে যোগান চাহিদাকে ছাপিয়ে যেতে শুরু করে, দাম উল্টোদিকে ঘুরে যায় এবং চার্টে একটা ঊর্ধ্বমুখী চূড়া তৈরি হয়।

সাপোর্ট ও রেজিস্ট্যান্স লাইন

অনুভূমিক সাপোর্ট-রেজিস্ট্যান্স লাইন

চার্টে পূর্বকালীন দামের যে পয়েন্টগুলোয় দাম উল্টোদিকে ঘুরে যায় সেখানে ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী চুড়া তৈরি হয়। ঐ চূড়াগুলোকে যোগ করে সাপোর্ট বা রেজিস্ট্যান্স-এর অনুভূমিক লাইন পাওয়া যায়।

সাধারণত বেশিরভাগ সাপোর্ট পয়েন্ট বা একই লেভেলের নিম্নমুখী চূড়াগুলোকে যোগ করে সাপোর্ট লাইন তৈরি হয় আর উল্টোদিকে রেজিস্ট্যান্স পয়েন্ট বা একই লেভেলের ঊর্ধ্বমুখী চূড়াগুলোকে যোগ করে রেজিস্ট্যান্স লাইন পাওয়া যায়।

সাপোর্ট রেজিস্ট্যান্স লাইন
সাপোর্ট ও রেজিস্ট্যান্স লাইন

উপরের ছবিতে নীল অনুভূমিক লাইনটা সাপোর্ট লাইন এবং কমলাটা রেজিস্ট্যান্স লাইন।

হেলানো ট্রেন্ড লাইন

অনেক সময় বাজার যখন কোনো একটা ট্রেন্ড অনুসরণ করে চলে তখন সাপোর্ট বা রেজিস্ট্যান্স পয়েন্টগুলো মানে চুড়াগুলো এক সমতলে না তৈরি হয়ে সময়ের সাথে সাথে ক্রমাগত উপর দিকে (আপ ট্রেন্ডের ক্ষেত্রে) বা নীচের দিকে (ডাউন ট্রেন্ডের ক্ষেত্রে) তৈরি হয়। এক্ষেত্রে যখন কিছু চূড়াকে যোগ করে একটা হেলানো লাইন পাওয়া যায় তখন তাকে ট্রেন্ডলাইন বলে।

উপরের অনুভূমিক সাপোর্ট বা রেজিস্ট্যান্স লাইনের মতোই এক্ষেত্রেও নিম্নমুখী দাম যখন কোনো ট্রেন্ড লাইনকে ছুঁয়ে ঘুরে গিয়ে উপর দিকে উঠতে আরম্ভ করবে তখন সেই ট্রেন্ড লাইনকে সাপোর্ট ট্রেন্ড লাইন ধরা হবে আর ঊর্ধ্বমুখী দাম যখন কোনো ট্রেন্ডলাইনকে ছুঁয়ে উল্টো দিকে নেমে আসতে চাইবে তখন সেটাকে রেজিস্ট্যান্স ট্রেন্ড লাইন ধরা হবে।

ট্রেন্ড লাইন
ট্রেন্ড লাইন

মুভিং অ্যাভারেজ লাইন

একটু আগে যে মুভিং অ্যাভারেজ ইন্ডিকেটরের কথা বলেছি সেটা আগের দুই লাইনের মতো নিজেকে আঁকতে হয়না। ইন্ডিকেটর অন করে নিলেই ওভারলে হিসাবে চার্টের উপর চলে আসে।

উপরের দুই লাইনের মতোই এক্ষেত্রেও কখনো কখনো দাম এই লাইন ছুঁয়ে ঘুরে যাওয়ার প্রবনতা দেখায়। মানে এটাও কখনো কখনো সাপোর্ট বা রেজিস্ট্যান্স হিসেবে কাজ করে।

মুভিং অ্যাভারেজ লাইন
বি দ্রঃ উপরের তিন ক্ষেত্রেই বাস্তবে এগুলো নিখুঁতভাবে অনুসৃত হয়না। তাই প্রয়োগের সময় রেখার বদলে রেখার দুই দিকে সাপোর্ট ও রেজিস্ট্যান্স জোন বা মন্ডল ধরে নেওয়া হয়।

দাম রেজিস্ট্যান্স বা সাপোর্ট জোনে যাওয়ার পরে কী ঘটনা ঘটে?

রেজিস্ট্যান্স বা সাপোর্ট জোনে দাম পৌঁছানোর পর দাম বারে বারে উল্টোদিকে ঘুরে গিয়ে চুড়াগুলো তৈরি হয় বলেই বলেই এই জোনগুলো পাওয়া যায়। কিন্তু তাই বলে এই নয় যে সবসময়ই এই জোনগুলো থেকে দাম উল্টোদিকে ঘুরে যায়। কখনো কখনো এই জোন লঙ্ঘন করে দাম উপরে বা নিচেও নেমে যায়, যাকে ব্রেকআউট বলে।

আরও পড়ুনঃ  সক্রিয় শেয়ার ট্রেডিং-এর 4 ধরণ। নতুন ট্রেডারদের এগুলো জানা চাই-ই-চাই।

যে লাইন লঙ্ঘিত হয়ে ব্রেকআউট হয় সেই লাইন বিপরীত লাইনে পরিবর্তিত হয়। মানে সাপোর্ট লাইন লঙ্ঘিত হলে সেটা রেজিস্ট্যান্স লাইনে পরিণত হয় আর রেজিস্ট্যান্স লাইন লঙ্ঘিত হলে সেটা সাপোর্ট লাইনে পরিণত হয়।

বিনিয়োগে উপরিউক্ত তত্ত্বের প্রয়োগ

এতক্ষণ উপরে যে সমস্ত তত্ত্বের কথা বললাম এবার সেগুলো প্রয়োগের পালা…

যেহেতু আমাদের মূল লক্ষ্য দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ তাই যেমনটা এই নিবন্ধের প্রথমেই বলে এসেছি, সেইমত টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে এক বা একাধিক ভালো এন্ট্রি পয়েন্ট বা বিনিয়োগের ভালো সুযোগ খুঁজে বের করা। আর শেয়ারের দাম যখন কোনো শক্তিশালী সাপোর্ট জোনে আসে তখনই হচ্ছে সেই সুবর্ণ সুযোগ!

এক্ষেত্রে আরও একবার বলে রাখি, এই তত্ত্ব ব্যবহারের আগে ফান্ডামেন্টাল অ্যানালাইসিস করে বিনিয়োগের জন্য ভালো শেয়ার বেছে নিতে হয় যাতে সমস্ত পরিস্থিতিতে তার উপর ভরসাটা অব্যাহত রাখা যায়। পরিস্থিতি যেমনই হোক শেয়ার বাছাই করে পুরো আত্মবিশ্বাস নিয়ে একবার বিনিয়োগ শুরু করার পর বিনিয়োগের মূল নীতি অনুযায়ী বেচার কথা আমরা এখানে ভাবব না এবং তাই এক্সিট পয়েন্ট ও রেজিস্ট্যান্স জোনকেও এক্ষেত্রে ধর্তব্যের বাইরে রাখব।

শক্তিশালী সাপোর্ট জোন

এতক্ষন যে সাপোর্ট জোনের কথা হচ্ছে তেমন সাপোর্ট জোন চার্ট খুললে অনেক জায়গাতেই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সব সাপোর্ট জোন-ই তো আর বিনিয়োগ করার জন্য উপযুক্ত হতে পারে না…। তাই বিনিয়োগের জন্য শক্তিশালী সাপোর্ট জোন খোঁজা প্রয়োজন। আর এটা খোঁজার জন্য,

  • বড় সময়ের টাইম ফ্রেমের (যেমন দিন বা সপ্তাহ) চার্ট ব্যবহার করতে হবে। টাইম ফ্রেম যত বড় হয় বা সাপোর্ট জোনের দৈর্ঘ্য যত বড় হয় সেটা তত শক্তিশালী হয়।
  • অনুভূমিক সাপোর্ট বা ট্রেন্ড লাইন আঁকার সময় চেষ্টা করতে হবে যেন যত বেশি সম্ভব চূড়া স্পর্শ করে। এই লাইনগুলো যত বেশী চূড়া ছোঁয় তত শক্তিশালী হয়।
  • একসাথে একাধিক সাপোর্ট লাইনের ব্যবহার করতে হবে। যে জোনটা একাধিক সাপোর্ট জোনের মধ্যে পড়ে সেটা বেশী শক্তিশালী হয়।
  • এই আঁকা লাইনগুলোর পাশাপাশি বিবিধ ইনডিকেটর কি বলছে সেটাও দেখে নিতে হবে।

শক্তিশালী সাপোর্ট জোন খুঁজতে ইন্ডিকেটরের ব্যবহার

এক্ষেত্রে অনেক ইন্ডিকেটরই ব্যবহার করা যায়, তবে বিষয়টাকে সহজ সরল রাখতে কেবলমাত্র উপরে উল্লিখিত তিনটে ইন্ডিকেটরই ব্যবহার করব। 

#১ ইএমএ – এক্ষেত্রে একটু বড় লেন্থের যেমন ৫০, ১০০ বা সুবিধেমত অন্য কোনো নম্বর সেট করে দেখতে হবে লাইনটা বেশী বেশী সোজা/ উল্টো চূড়ায় ঠেকছে কিনা। তারপর দেখতে হবে এটাও ঐ আগের লাইনগুলো থেকে পাওয়া সাপোর্ট জোনকে সাপোর্ট করছে কিনা কিংবা ঐ জোনটা এই লাইনের নীচে (ওভারসোল্ড বা অতিরিক্ত বেচার জোন) আছে কিনা। সাপোর্ট জোন এই লাইনের যত কাছে বা যত নীচে থাকে তত শক্তিশালী হয়। আবার এই লাইন থেকে উপরের দিকে যত বেশি দূরে যায় তত বেশি দুর্বল হয় কারণ সেটা ওভারবট (অতিরিক্ত কেনার) জোন নির্দেশ করে। তাই এই লাইন থেকে উপরের দিকে বেশি দূরে বিনিয়োগ করার জন্য ভালো জায়গা না।

#২ আর এস আই – আর এস আই যত কম থাকে সাপোর্ট জোন তত শক্তিশালী হয়। এটা এমনিতে ০ থেকে ১০০-র মধ্যে হতে পারে। তবে সাধারণত ৭০-র উপরে হলে ওভারবট ধরা হয় আর ৩০ এর নিচে হলে ওভারসোল্ড ধরা হয়। 

#৩ ভলিউম – শেয়ারের দাম নিচের দিকে নামার পর সাপোর্ট জোনে থাকাকালীন সময়ে যদি ক্রমাগত ভলিউম বাড়তে আরম্ভ করে তাহলে রিভার্সাল ঘটার বা দাম উল্টোদিকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি হয়। তাই সাপোর্ট জোনে ক্রমবর্ধমান ভলিউম একে আরও শক্তিশালী করে।

শক্তিশালী সাপোর্ট জোন বেছে নেওয়ার পরেও যদি দাম পড়ে যায়?

শেয়ার বাজার বউ-এর মতো, ভীষণই আনপ্রেডিক্টেবল। যতই সবকিছু বুঝে শুনে করা হোক না কেন, এখানে অপ্রত্যাশিত ঘটনাও হামেশাই ঘটে থাকে। সাধারণত সাপোর্ট জোন খুব শক্তিশালী হলে সেটা লঙ্ঘিত হয় না এবং সাধারণত সেখান থেকে দাম উপরের দিকেই ওঠে। কিন্তু ঐযে বললাম… কখনো কখনো মহাশক্তিশালী সাপোর্ট জোনও লঙ্ঘিত হয় এবং তার পরেও শেয়ারের দাম পড়তে থাকে।

তো এক্ষেত্রে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। যেহেতু আগেই ফান্ডামেন্টাল্‌স অনুযায়ী যোগ্য কোম্পানি বেছে তবে বিনিয়োগ শুরু করা হয়েছে তাই দাম পড়ুক বা বাড়ুক যাই হোক লম্বা সময়ের বিচারের দাম বাড়বে সেটা ধরে নিয়ে পরের সাপোর্ট জোনে আবার কিছু বিনিয়োগের জন্য তৈরি থাকতে হবে। এজন্য আগেই বিনিয়োগের মোট অর্থকে কয়েক ভাগে ভেঙে তবে বিনিয়োগ শুরু করা উচিৎ। এছাড়া আলাদা করে আরও টাকা ঢোকানোর জন্যও এই পন্থা ব্যবহার করা যেতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  কেবলমাত্র ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিটে টাকা রেখে যারা ঠকছেন তাদের জন্য শেয়ার বাজারে পা রাখার দিশা।

তবে ‘বিনিয়োগে বিক্রি নয়’- এই ভাবনায় চললেও কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগেও কখনো কখনো বিক্রি করার প্রয়োজন পড়ে বটে। কখন বিক্রির কথা ভাববেন সে বিষয়ে বিশদে জানতে হলে এই আর্টিকেলটা পড়ে নিতে পারেন। আর বিক্রি যদি করতেই হয়, সেক্ষেত্রে কেনার উল্টো শর্তে, মানে যেকোনো রেজিস্ট্যান্স জোন বিক্রির জন্য উপযুক্ত হবে।

উদাহরণ

উপরের ছবিটা এয়ারটেলের সাপ্তাহিক টাইম ফ্রেমের বিগত ১৬ বছরের চার্ট। এক্ষেত্রে আমি ধরে নেব ফান্ডামেন্টাল্‌স অনুযায়ী এটা বিনিয়োগের জন্য নিখুঁত একটা শেয়ার। এখানে নিচের লম্বা কমলা লাইনটা দীর্ঘকালীন অনুভূমিক সাপোর্ট লাইন। এর উপরের বেগুনি অনুভূমিক লাইন দুটো এক সময়ে রেজিস্ট্যান্স লাইন থাকলেও সম্প্রতি লঙ্ঘিত হওয়ার পরে সাপোর্ট লাইনে পরিণত হয়েছে। উপরের ছোটো কমলা লাইনটা সাম্প্রতিক সাপোর্ট লাইন। হেলানো নীল লাইন দুটো ট্রেন্ড লাইন, যেগুলো সাপোর্ট হিসাবে কাজ করছে। হেলানো বেগুনি লাইনটাও একটা ট্রেন্ড লাইন যেটা রেজিস্ট্যান্স থেকে বর্তমানে সাপোর্টে পরিণত হয়েছে। মাঝের আঁকাবাঁকা আকাশি লাইনটা ইএমএ-১০০ ইন্ডিকেটরের লাইন। চার্টের নীচের দিকে আছে ভলিউমের কলাম চার্টের ওভারলে আর মূল চার্টের বাইরে একেবারে নীচে আছে আরএসআই এর লাইন।

এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বহু বছর ধরে শেয়ারের দাম ২৬০ এর সাপোর্ট জোন থেকে ৪০০-র রেজিস্ট্যান্স জোনের মধ্যে ওঠাপড়া হয়েছে। ইদানিংকালে দাম ৪০০ ও তারপর ৫০০-র রেজিস্ট্যান্স জোন লংঘন করে উপর দিকে উঠেছে।

২০০৭-এর শেষে ১নং কমলা তীর চিহ্নের কাছে বিনিয়োগ করে বসে থাকলে পজিটিভ রিটার্ন পেতে পেতে 2021 পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। সুতরাং শেয়ারটা ভালো হলেও ওই জায়গায় বিনিয়োগ করা মোটেও ভালো কাজ হতো না। ওটার মতই ২ বা ৩ নম্বর কমলা তীর চিহ্নের জায়গায় বা সাপোর্ট লাইনের কাছে অন্য যেকোনো চূড়ার জায়গায় বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগের রিটার্ন পেতে অনেক বেশি সময় লাগতো। ভালো করে দেখলে দেখা যাবে এই জায়গা গুলো সাপোর্ট লাইনের কাছাকাছি থাকার পাশাপাশি ইএমএ লাইনেরও অনেক উপরে আছে এবং ঐ জায়গায় আরএসআই-ও অনেক বেশি।

অন্যদিকে প্রথম দুটো নীল তীর চিহ্নের জায়গাগুলো যেমন দীর্ঘকালীন ট্রেন্ড ও অনুভুমিক সাপোর্ট লাইনের কাছে আছে তেমনই ইএমএ লাইনেরও অনেকটা নীচে আছে। এছাড়া ঐ জায়গাগুলোয় আরএসআই ৩০-এর কম। তাই এই দুটো নীল তীর চিহ্নের জায়গা বা এই সাপোর্ট লাইনের কাছে যেকোনো জায়গা বিনিয়োগ শুরু করার জন্য বা নতুন পজিশন অ্যাড করার জন্য উপযুক্ত ছিল। ৩ নং নীল তীর চিহ্নের জায়গাটাতে রেজিস্ট্যান্স থেকে সাপোর্টে পরিণত হওয়া বেগুনি লাইনের সাপোর্ট থাকায় এবং ইএমআই ও আরএসআই এর সিগন্যাল-ও ঠিকঠাক থাকায় ওটাও বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত জায়গা ছিল।

সাম্প্রতিক কালে বিনিয়োগের জন্য বেগুনি তীর চিহ্নের জায়গাটা উপযুক্ত ছিল। কারণ ওখানে ২টো ট্রেন্ড লাইনের, একটা অনুভুমিক লাইনের এবং ইএমএ-র সাপোর্ট থাকার পাশাপাশি আরএসআই কম ছিল এবং তার সাথে ভলিউম-ও ক্রমবর্ধমান ছিল।

তবে এই মুহূর্তে এই স্টকে বিনিয়োগ করতে চাইলে উপরে বর্ণিত জায়গাগুলোর মতো ঠিকঠাক সিগন্যাল বা শক্তিশালী সাপোর্ট জোন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই উচিৎ হবে।

শেষ কথা

এতক্ষন যা হল সবটাই থিওরি। এগুলো প্র্যাকটিক্যালি অ্যাপ্লাই করতে হলে নিজেকে চার্ট খুলে বসতে হবে, টাইম ফ্রেম পরিবর্তন করে কেমন দেখায় দেখতে হবে, সাপোর্ট-রেজিস্ট্যান্স ও ট্রেন্ড লাইন আঁকি-বুকি করতে হবে এবং বিভিন্ন ইন্ডিকেটর নিয়ে পরীক্ষা নিরিক্ষা করতে হবে। তবেই আপনি ধীরে ধীরে এই বিষয়ে পাকা খেলোয়াড় হয়ে উঠবেন।

আজ তাহলে এখানেই শেষ করি। ভালো থাকবেন। 🙂

দাবিত্যাগঃ উপরে যে সমস্ত শেয়ারের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে সেগুলো কোনো স্টক রেকমেন্ডেশন নয়। ওইগুলো দেখেই দয়া করে দুম করে বিনিয়োগ করে বসবেন না। বিষয়বস্তু বোঝানোর জন্য উদাহরণ হিসাবে ওগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে দেওয়া উদাহরণ দেখে বিনিয়োগ করে কেস খেলে আমায় দায়ী করবেন না পিলিজ!

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস শিখব কিভাবে?

কোনো নতুন জিনিস শিখতে চাইলে যা করতে হয় তাই করতে হবে। মানে বই পড়ে, ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে বা ভালো বিশ্বাসযোগ্য ট্রেনার পেলে তার কাছে কোর্স করে শেখা যেতে পারে। এছাড়া এই ব্লগ থেকেও এই সংক্রান্ত অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারবেন।

টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস কি সত্যিই কাজ করে?

অবশ্যই! এখানে দেওয়া উদাহরণটায় সেটা পরিষ্কার। তবে এটাও ঠিক যে এটা ১০০% কার্যকরী হয় না।

মন্তব্য করুন