মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে একটু পড়াশোনা বা রিসার্চ করতে গেলেই প্রচুর অচেনা টার্ম বা পরিভাষা সামনে আসে। আর ঐ সমস্ত টার্মগুলো সম্পর্কে জানা না থাকলে এই ফান্ডের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ভালোভাবে বোঝাটাই চাপের ব্যাপার হয়ে যায়।
তাই এই নিবন্ধে মিউচুয়াল ফান্ড সম্পর্কিত বিভিন্ন রকম নতুন টার্ম বা পরিভাষাগুলো সম্পর্কে আলোচনা করব যাতে এই বিষয়ে সবকিছুই আপনার কাছে জলবৎ তরলং হয়ে যায়!
অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বা ফান্ড হাউস
অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, এএমসি আর ফান্ড হাউস একই জিনিসের বিভিন্ন নাম। এটা বলতে বোঝায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত যেসব কোম্পানি মিউচুয়াল ফান্ড লঞ্চ ও ম্যানেজ করে সেই সমস্ত কোম্পানিগুলোকে। এই যেমন ধরুন এইচডিএফসি এএমসি এমনই একটা ফান্ড হাউসের উদাহরণ।
নিউ ফান্ড অফারিং বা এনএফও
একটা কোম্পানি বা স্টক প্রথমবারের জন্য শেয়ার বাজারে লিস্টেড হয় আইপিও বা ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং-এর মাধ্যমে। একইভাবে যখন কোনো এএমসি একটা নতুন মিউচুয়াল ফান্ড শুরু করতে চায় এবং সেই উদ্দেশ্যে ইনভেস্টারদের টাকা একত্রিত করতে চায় তখন তারা নিউ ফান্ড অফারিং বা এনএফও নিয়ে আসে।
অ্যাসেট আন্ডার ম্যানেজমেন্ট বা এইউএম
একটা মিউচুয়াল ফান্ডের মোট ভ্যালুই হচ্ছে অ্যাসেট আন্ডার ম্যানেজমেন্ট। অর্থাৎ একটা ফান্ডে সমস্ত বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা টাকার যোগফলই হচ্ছে এই এইউএম। যেকোনো সময়ে একটা ফান্ডের পুরো টাকার কিছু অংশ বিবিধ অ্যাসেটে বিনিয়োগ করা থাকে এবং কিছু অংশ ক্যাশ হিসাবে থাকে। এই দুই অংশই এইউএম এর অন্তর্গত।
নেট অ্যাসেট ভ্যালু বা এনএভি
প্রত্যেক কোম্পানির পুরো মালিকানার ছোটো ছোটো অংশকে শেয়ার বলা হয়। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ বা ট্রেডিং ঐ শেয়ার কেনাবেচার মাধ্যমেই হয়। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একইরকম ভাবে পুরো ফান্ডকে ছোটো ছোটো ইউনিটে ভেঙে তারপর সেই ইউনিটের কেনাবেচা করা হয়। আর একটা ইউনিটের ভ্যালু বা দামকেই নেট অ্যাসেট ভ্যালু বা এনএভি বলে যা আসলে শেয়ারের দামেরই সমকক্ষ। একটা ফান্ডের নির্ধারিত ইউনিট সংখ্যা দিয়ে এইউএম বা অ্যাসেট আন্ডার ম্যানেজমেন্ট-কে ভাগ করলে এটা পাওয়া যায়।
বেঞ্চমার্ক
যেকোনো মিউচুয়াল ফান্ডের পারফরম্যান্স বা রিটার্ন কেমন সেটা ফান্ডটাকে আলাদাভাবে বিচার করে বোঝা সম্ভব নয়। তাই যেকোনো ফান্ডের রিটার্ন তুলনামূলক ভাবে বোঝার জন্য একটা মাপকাঠির প্রয়োজন পড়ে। আর সেই মাপকাঠির নামই বেঞ্চমার্ক। ফান্ডের সাথে সম্পর্কিত ইনডেক্স বা উল্টে বললে যে ইনডেক্সের উপর ভিত্তি করে ফান্ড গঠন করা হয় সেটাকেই ফান্ডের বেঞ্চমার্ক ইনডেক্স বলে।
যেমন, নিফটি ৫০ অনুসরণ করে তৈরি যেকোনো মিউচুয়াল ফান্ডের বেঞ্চমার্ক ইনডেক্স হচ্ছে নিফটি ৫০।
আলফা
ফান্ড বা ফান্ড ম্যানেজারের পারফরম্যান্স মাপার একটা স্কেল হল আলফা। যখন মিউচুয়াল ফান্ডের রিটার্ন সেটার বেঞ্চমার্ক ইনডেক্সের থেকে বেশী হয় তখন আলফা পজিটিভ হয় আর কম হলে নেগেটিভ হয়।
বিটা
বাজারের তুলনায় ফান্ডের স্পর্শকাতরতাকে বিটা বলে। প্রত্যেক ফান্ডের ভ্যালু সমগ্র বাজারের তুলনায় যেভাবে বাড়ে বা কমে তা বিটা দিয়ে মাপা হয়। বাজারের বিটা ১ ধরে কোনো ফান্ডের বিটা এর বেশি মানে ধরে নিই যদি ১.২ হয় তাহলে বুঝতে হবে বাজার ১০০ পয়েন্ট বাড়লে ফান্ডের ভ্যালু বাড়বে ১০০*১.২=১২০ পয়েন্ট।
তবে এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, হাই বিটা ফান্ডে যেমন বেশি রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তেমনই ঝুঁকিটাও বেশি থাকে।
লোড
লোড মানে এক কথায় কেনাবেচার সময় দেয় অতিরিক্ত চার্জ। এটা প্রধানত দুই ধরনের হয় যথা এন্ট্রি বা ফ্রন্ট এন্ড লোড এবং এক্সিট লোড।
এন্ট্রি লোড
ফান্ডের ইউনিট কেনার সময় যে চার্জ দিতে হয় সেটাকে এন্ট্রি লোড বলে। তবে ইদানিংকালে বেশিরভাগ ফান্ডেই এই চার্জ নেওয়া হয় না।
এক্সিট লোড
ইউনিট রিডিম করার সময় বা বিক্রি করে টাকা ফেরত নেওয়ার সময় যে চার্জ দিতে হয় তাকে এক্সিট লোড বলে। বিনিয়োগকারীদের ইউনিট রিডিম করা থেকে নিরস্ত করতেই এই চার্জ নেওয়া হয়।
এক্সপেন্স রেশিও
ফান্ডের যে অংশটা প্রতি বছর ফান্ড সম্পর্কিত বিবিধ খরচ মেটাতে চলে যায়, সেটা ফান্ডের মোট অ্যাসেটের যত শতাংশ তাকেই এক্সপেন্স রেশিও বলে। ফান্ড বেছে নেওয়ার সময় এটা দেখে নিতে হয়। কারণ, এই এক্সপেন্স রেশিও যত বেশী হয় রিটার্ন তত কমে যায়।
গ্রোথ স্কিম
যে ধরণের স্কিমে সাধারণত ইকুইটি বা এই সম্পর্কিত ইন্সট্রুমেন্টে বিনিয়োগ করা হয় এবং লভ্যাংশ ফান্ডে পুনর্বিনিয়োগ করা হয় সেগুলোকে গ্রোথ স্কিম বলে। এক্ষেত্রে কোনো ডিভিডেন্ড পাওয়া যায়না। মিউচুয়াল ফান্ডের নামের শেষ দিকে এটা উল্লেখ করা থাকে।
ডিভিডেন্ড স্কিম
গ্রোথ স্কিমের ঠিক উল্টো হচ্ছে ডিভিডেন্ড স্কিম। এক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সময়ে সময়ে ডিভিডেন্ড দেওয়া হয়। ‘গ্রোথ’-এর মতো এটাও মিউচুয়াল ফান্ডের নামের শেষ দিকে উল্লিখিত থাকে।
রেগুলার প্ল্যান
মিউচুয়াল ফান্ডের নামের শেষে অনেকসময় ‘রেগুলার’ বলে আরও একটা টার্ম দেখা যায়। ফান্ড ডিস্ট্রিবিউটর বা এজেন্টের মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে চাইলে ডাইরেক্ট প্ল্যানই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ফান্ডের এক্সপেন্স রেশিও বেশি হয় কারণ খরচের মধ্যে ডিস্ট্রিবিউশন চার্জ যোগ হয়।
ডাইরেক্ট প্ল্যান
রেগুলার প্ল্যানের উল্টো প্ল্যান ডাইরেক্ট। ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমে বিনিয়োগ না করে সরাসরি করলে ডাইরেক্ট প্ল্যানই বেছে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ডিস্ট্রিবিউশন চার্জ লাগেনা বলে এক্সপেন্স রেশিও তুলনায় কম হয়।
ওপেন এন্ডেড স্কিম
যে ধরণের মিউচুয়াল ফান্ডে যখন খুশি বিনিয়োগ করা যায় বা ইউনিট কেনা-বেচা যায় সেগুলোকে ওপেন এন্ডেড স্কিম বলে। এগুলোর কোনো ম্যাচুরিটি পিরিয়ড থাকে না এবং এধরনের ফান্ডে যতদিন খুশি বিনিয়োগ করে থাকা যায়।
ক্লোজ এন্ডেড স্কিম
এ ধরনের ফান্ডে শুধুমাত্র নিউ ফান্ড অফার বা এনএফও-র সময়েই বিনিয়োগ করা যায় এবং স্কিমের ম্যাচুরিটির পর ইউনিট রিডিম করা যায়। তবে অনেক ক্লোজ এন্ডেড ফান্ড ম্যাচুরিটির পর ওপেন এন্ডেড হয়ে যায় কিংবা অনেক সময় এগুলোতে ম্যাচুরিটির পর অন্য ওপেন এন্ড ফান্ডে টাকা ট্রান্সফারের অপশন পাওয়া যায়।
তবে এধরণের ফান্ড সাধারণত এক্সচেঞ্জে লিস্টেড হয় এবং ম্যাচুরিটির আগে টাকা ফেরত পেতে চাইলে রিডিম না করেই অন্য বিনিয়োগকারীকে ইউনিট বেচে দিয়ে টাকা ফেরত পাওয়া যায়।
ফোলিও নম্বর
ব্যাংকে টাকা রাখলে যেমন একটা নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর বরাদ্দ করা হয়, ঠিক তেমনি মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা রাখলে প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্ট আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য একটা নির্দিষ্ট ও অনন্য ফোলিও নম্বর বরাদ্দ করা হয়।
সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান বা এসআইপি
ব্যাংকে যেমন রেকারিং ডিপোজিট হয় ঠিক তেমনি মিউচুয়াল ফান্ডে হয় এসআইপি। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় অন্তর পছন্দের কোনো ফান্ডে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়মিত বিনিয়োগের সুযোগ পাওয়া যায়। বেশিরভাগ স্কিমেই নূন্যতম ৫০০ বা ১০০০ টাকা থেকে শুরু করে মাসিক, ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক বা বার্ষিক এসআইপি করা যায়।
সিস্টেমেটিক ট্রান্সফার প্ল্যান বা এসটিপি
একই ফান্ড হাউসের এক ফান্ড থেকে অন্য ফান্ডে নির্দিষ্ট সংখ্যক ইউনিট বা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নির্দিষ্ট সময় অন্তর ট্রান্সফার করার প্ল্যানই হল সিস্টেমেটিক ট্রান্সফার প্ল্যান বা এসটিপি।
একটা ফান্ডে এককালীন মোটা অঙ্কের একটা টাকা বিনিয়োগ করার পর ফান্ড হাউসে এমনভাবে এসটিপি ইন্সট্রাকশন দেওয়া যেতে পারে যাতে ওই প্রথম ফান্ড থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ বা নির্দিষ্ট সংখ্যক ইউনিটের সমকক্ষ টাকা নিয়মিত এবং নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয় একটা ফান্ডে ট্রান্সফার হয়ে যায়। প্রথম ফান্ডে টাকা ফুরিয়ে গেলে এই ট্রান্সফার বন্ধ হয়ে যায়।
এটা বিনিয়োগের ঝুঁকি কম করার একটা স্ট্র্যাটেজি। সাধারণত বাজারের পরিস্থিতি অনুযায়ী কখনও এর মাধ্যমে প্রথমত ডেট ফান্ডে বিনিয়োগ করে ধীরে ধীরে ইকুইটি ফান্ডে টাকা পাঠানো হয় বা কখনও তার উল্টোটা করা হয়।
সিস্টেমেটিক উইথড্রয়াল প্ল্যান বা এসডব্লিউপি
এসটিপি-র মতোই ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে টাকা তুলে নেওয়ার প্ল্যান কে সিস্টেমেটিক উইথড্রয়াল প্ল্যান বলে। এর মাধ্যমে নিজের বিনিয়োগ ভাঙিয়ে নিয়মিত ইনকামের মতো টাকা হাতে পাওয়ার একটা ব্যবস্থাপনা তৈরি করা যায়।
রিডিম
মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা টাকা দুইভাবে ফেরত পাওয়া যেতে পারে, প্রথমত অন্য কোনো বিনিয়োগকারীকে ইউনিট বেচে দিয়ে আর দ্বিতীয়ত সরাসরি ফান্ড হাউসের কাছে ইউনিট বেচে বা ফেরত দিয়ে। এই দ্বিতীয় উপায়ে টাকা ফেরত পাওয়াকেই রিডিম করা বলে। রিডিম করার সময় বিনিয়োগকারী তখনকার এনএভি থেকে কোনো এক্সিট লোড থাকলে সেটা বাদে টাকা ফেরত পায়।
শেষ কথা
উপরে দেওয়া টার্মের অর্থগুলো আপনার মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের জার্নিটা অনেক সহজ করবে বলে আশা রাখি। এই ব্যাপারে আরও অন্যান্য টার্ম ও কনসেপ্ট আগে পাবলিশ করা অন্যান্য আর্টিকেল থেকে জানতে পারবেন। ঐ আর্টিকেলের তালিকাটা নীচে দিলামঃ
মিউচুয়াল ফান্ড কত ধরণের হয়? সঠিক ও ভালো মিউচুয়াল ফান্ড চেনার উপায়। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের সুবিধা ও অসুবিধা। মিউচুয়াল ফান্ডে কী কী উপায়ে বিনিয়োগ করা যায়?
আজ তাহলে এখানেই ইতি টানি। ভালো থাকবেন।