জমি বাড়ি না কিনেই 300 টাকায় রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ। আরইআইটি

5/5 - (4 জন রেটিং করেছেন)

বিনিয়োগের জন্য বা আয়ের অতিরিক্ত একটা রাস্তা তৈরি করার জন্য জায়গা, জমি, বাড়ি বা অন্য যেকোনো ধরণের ভুসম্পত্তি কিনে ভাড়া দেওয়া খুবই প্রচলিত এবং পুরানো একটা উপায়। কিন্তু এসব করতে গেলে সবার প্রথমে যেটা দরকার পড়ে সেটা হচ্ছে মোটা অঙ্কের পুঁজি। তাছাড়া এই পথে বিনিয়োগের সাথে ফ্রিতে চলে আসে এসব কেনা, ভাড়া দেওয়া আর রক্ষণাবেক্ষণের ঝামেলা। উপরন্তু হঠাৎ টাকার দরকার পড়লে এ ধরনের সম্পত্তি দুম করে বেচে দেওয়াও অতটা সহজ হয় না। তবে আশার কথা হচ্ছে আজকের দিনে পর্বতপ্রমাণ পুঁজি না থাকলেও এবং এর সাথে জড়িত ঝামেলাগুলো এড়িয়েও এই উপায়ে মানে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করে আয়ের একটা রাস্তা তৈরি করা যায়।

আর এটা করার জন্য যা প্রয়োজন পড়ে সেটার নাম হচ্ছে ইকুইটি আরইআইটি (REIT) বা রিট। এই নিবন্ধে আমরা জেনে নেব এই ইকুইটি আরইআইটি কী, কিভাবে কাজ করে, বিনিয়োগ কিভাবে করা যায় এবং এভাবে বিনিয়োগের সুবিধা ও অসুবিধা গুলো কী কী?

ইকুইটি আরইআইটি (REIT) বা রিট কী?

ধরুন অভিজিৎ আমার একজন বন্ধু। ও একজন বড়সড় প্রোমোটার এবং বিভিন্ন কমার্শিয়াল প্রপার্টি কিনে ভাড়া দেওয়াই ওর ব্যবসা। এমনিতে ও বিশাল পয়সাওয়ালা কিন্তু ওর ব্যবসার ক্ষেত্রে যে পুঁজির দরকার পড়ে সেটা আরও বিশাল। যথারীতি ওকে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কাজ চালাতে হয়। কিন্তু ব্যাংক লোন মানে এমনিতে তো বোঝা-ই, তার উপর ব্যবসা ভালো বা খারাপ যেমনই চলুক নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সুদের হারে সুদসহ আসলটা ঠিক মিটিয়ে যেতে হয়।

এই লোনের সমস্যা কিছুটা লাঘব করতে একদিন ও আমাকে এবং আমাদের গ্রুপের আরো কয়েকজন বন্ধুকে জড়ো করলো। তারপর ও আমাদেরকে ওর ব্যবসার মালিকানার বদলে বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দিল। তার বদলে প্রপার্টির ভাড়া থেকে নিয়মিত যে আয় হয় তার সিংহভাগ বিনিয়োগের (ইউনিটের) অনুপাতে ও আমাদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। সঙ্গে এও বলল ভবিষ্যতে আমরা মূলধন ফেরত পেতে চাইলে অন্য কাউকে ঐ ইউনিট বা মালিকানা বিক্রি করে আমাদের টাকা তুলেও নিতে পারব। আর সেক্ষেত্রে সেসময়ে প্রপার্টির দাম, কোম্পানির পারফরম্যান্স এবং চাহিদা অনুযায়ী ইউনিটের বাজারমুল্য কেনার দামের থেকে বেশি হলে বিনিয়োগীকৃত টাকার থেকে বেশি টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে। মানে আমরা দুই ভাবে লাভের সুযোগ পাব! 

আরও পড়ুনঃ  কখন শেয়ার বিক্রি করবেন? নতুন বিনিয়োগকারীদের জানা আবশ্যক।

আর অভিজিৎ এভাবে ওর কোম্পানির মালিকানা তথা লাভ আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার বদলে ব্যাংক লোন নেওয়ার ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে পারবে আর আমাদের টাকায় ব্যবসা আরও বড় করার সুযোগও পাবে। মানে এই ব্যবস্থাপনায় লাভ দুই পক্ষেরই।

ইকুইটি রিট বা আরইআইটি-র কনসেপ্টটা এইরকমই। আরইআইটি-র পুরো কথা রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট। এগুলো এমন এক ধরনের প্রতিষ্ঠান যাদের আয়-উৎপাদনকারী বিবিধ রিয়েল এস্টেট প্রপার্টি (প্রধানত কমার্শিয়াল) থাকে এবং এরা ঐসব প্রপার্টি কেনে, গড়ে তোলে, ভাড়া দেয় ও মেন্টেন করে। এদের আয়ের প্রধান উৎস হল প্রপার্টির ভাড়া বাবদ পাওয়া টাকা। এদের মালিকানার প্রপার্টির মধ্যে পড়ে শপিং মল, অফিস স্পেস, হোটেল ইত্যাদি।

বিভিন্ন কোম্পানি যেভাবে শেয়ার বাজারে আইপিও-র মাধ্যমে লিস্টেড হয় এ ধরনের কোম্পানিগুলোও একইভাবে আইপিও করে এবং শেয়ার বাজারে লিস্টেড হয়। তবে সাধারণত এ ধরনের কোম্পানিগুলো আর পাঁচটা সাধারণ কোম্পানির থেকে আলাদা হয়। কারণ একটা সাধারণ কোম্পানি যেখানে কোনও প্রোডাক্ট বানায় বা কিছু সার্ভিস দিয়ে থাকে এই কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র কিছু রিয়েল এস্টেট প্রপার্টির সম্ভার মাত্র। আর অন্যান্য কোম্পানি যেখানে বিভিন্ন সেক্টরের হতে পারে এগুলো কেবলমাত্র রিয়েল এস্টেট সেক্টরেই সীমাবদ্ধ। তাছাড়া এদের ক্ষেত্রে ডিভিডেন্ড দেওয়া বা ভাড়ার টাকা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া বাধ্যতামূলক হয়।

এ ধরনের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে হলে অন্যান্য লিস্টেড কোম্পানির মতই এগুলোর ক্ষেত্রেও কোম্পানির আংশিক মালিকানা হিসেবে আরইআইটি ইউনিট কিনতে হয় এবং সাধারণ শেয়ারের মতোই এগুলোও শেয়ার বাজারে ট্রেড-ও হয়। তাই পরে যখন খুশি এই ইউনিট অন্য ক্রেতাকে বিক্রি করে বিনিয়োগ করা টাকা সহজেই ফেরত-ও পাওয়া যায়।

এক্ষেত্রে আরো একটা কথা না বললেই নয়, ভারতবর্ষে এই রিটের আবির্ভাব হালফিল সময়েই হয়েছে। এখানে প্রথম রিটের আইপিও হয় 2019 সালে।

ইকুইটি ছাড়া অন্যান্য ধরণের আরইআইটি

এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগের সহজ উপায় খুঁজে বের করা। এতক্ষণ যে ইকুইটি আরইআইটির কথা বলছিলাম সেটাই সবথেকে বেশি প্রচলিত এবং সহজবোধ্য। কিন্তু এগুলো ছাড়াও আরো দুই ধরনের আরইআইটি হতে পারে। যথাঃ

  • মর্টগেজ আরইআইটিঃ এরা নিজেরা প্রপার্টির মালিক নয় তবে মর্টগেজের মাধ্যমে প্রপার্টি মালিকদের ফান্ড সরবরাহ করে। আর এদের আয় হয় সুদ পাওয়ার মাধ্যমে। তাই ইন্টারেস্ট রেট ওঠা-নামার প্রভাব এদের আয়ের উপরেও পড়ে।
  • হাইব্রিড আরইআইটিঃ ইকুইটি ও মর্টগেজ আরইআইটির হাইব্রিড হল হাইব্রিড আরইআইটি।
আরও পড়ুনঃ  শেয়ার বাজার কেন আছে? এর প্রয়োজন কী? না থাকলেই বা কী হত?

একটা কোম্পানির আরইআইটি হিসাবে কোয়ালিফাই করার শর্তাবলী

এক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে যাতে বিনিয়োগকারীরা কোনো সমস্যায় না পড়ে সেজন্য সেবি সমস্ত আরইআইটির জন্য কিছু গাইডলাইন সেট করে দিয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটা হল,

  • প্রতিষ্ঠানটার গঠন হতে হবে একটা ট্রাস্ট বা কর্পোরেশনের মত।
  • কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ থাকতে হবে।
  • সম্পদের কমপক্ষে ৮০% ভারতে অবস্থিত সম্পূর্ণ ও আয়-উৎপাদনকারী রিয়েল এস্টেট প্রোজেক্টে বিনিয়োগ করতে হবে।
  • অন্য আরইআইটি-তে বিনিয়োগ করা যাবেনা।
  • প্রতিবছর কমপক্ষে ৯০% ইনকাম বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ডিভিডেন্ড হিসাবে বন্টন করে দিতে হবে।

আরইআইটি-তে বিনিয়োগের সুবিধা 

এর মাধ্যমে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগের সুবিধাগুলো হলো,

  • নিয়মিত আয় ও ক্যাপিটাল বৃদ্ধিঃ ডিভিডেন্ড হিসেবে নিয়মিত আয় হয়। এছাড়া প্রপার্টির দাম বাড়ার সাথে সাথে ক্যাপিটাল বৃদ্ধির সুযোগও পাওয়া যায়।
  • ডাইভারসিফিকেশনঃ অল্প পুঁজিতে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে বিনিয়োগের মাধ্যমে পোর্টফোলিও ডাইভারসিফাই করা যায়।
  • স্বচ্ছ ও নিরাপদঃ এগুলো সেবির নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই এদের কর্মকান্ড অনেক স্বচ্ছ আর এখানে বিনিয়োগ করাও খুবই নিরাপদ।
  • লিকুইডঃ স্টকের মত শেয়ারবাজারে ট্রেড হয় বলে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগের অন্যান্য মাধ্যমের থেকে অনেক বেশি লিকুইডিটি থাকে, ফলে সহজেই কেনা বা বেচা যায়।

আরইআইটি-তে বিনিয়োগের অসুবিধা

এতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু কিছু অসুবিধাও আছে। যেমন,

  • ট্যাক্সে কোনরকম ছাড় পাওয়া যায় না।
  • শেয়ার বাজারের ট্রেড হয় বলে বাজার সংক্রান্ত ঝুঁকিতো থাকেই।
  • ক্যাপিটাল বৃদ্ধির হার কম হয় কারণ ভাড়ার আয়ের বেশিরভাগটাই ডিভিডেন্ড হিসাবে বন্টন করে দিতে হয়।
  • ব্যাংক ইন্টারেস্ট বাড়লে এক্ষেত্রে রিটার্নের হার কমে যেতে পারে।
  • অন্যান্য রিয়েল এস্টেট ইন্সট্রুমেন্টের তুলনায় বেশি লিকুইডিটি থাকলেও শেয়ারের মতো লিকুইড নয়।
  • চাহিদা কম থাকার জন্য প্রপার্টি ফাঁকা পড়ে থাকলে আয় কমে যেতে পারে।
  • ভারতবর্ষে এই মুহূর্তে মাত্র তিনটে আরইআইটি বর্তমান।

ভারতীয় শেয়ার বাজারে লিস্টেড আরইআইটি

ভারতীয় শেয়ার বাজারে লিস্টেড আরইআইটি গুলো হল…

আরও পড়ুনঃ  সোনায় বিনিয়োগ করার 7 টা উপায়। আমার পছন্দ #6
ক্রমিক সংখ্যাআরইআইটিসিম্বলইউনিটের বর্তমান দাম
মাইন্ডস্পেস বিজনেস পার্ক আরইআইটিMINDSPACE৩২৩
ব্রুকফিল্ড ইন্ডিয়া রিয়েল এস্টেট ট্রাস্টBIRET২৭৪
এম্বাসি অফিস পার্কস আরইআইটিEMBASSY৩২৯

উপরের দাম গুলো দেখে আশাকরি বুঝেই গেছেন এক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে বা যেকোনো একটা ইউনিট কিনতে কমবেশি মাত্র ৩০০ টাকা খরচ হয়।

কিভাবে আইআইটিতে বিনিয়োগ করা যায়?

ঠিক যেভাবে শেয়ারে বিনিয়োগ করা যায়, এক্ষেত্রেও বিনিয়োগের নিয়ম একই। একটা ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলে শেয়ারের মতোই আরইআইটি ইউনিট কেনা বা বেচা যায়। এছাড়া আইপিও-র সময়ও বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

বিনিয়োগ করার আগে কোন কোন বিষয়গুলোর উপর খেয়াল রাখা উচিত?

যেকোনো শেয়ার কেনার আগে যেমন কোম্পানিটা সম্পর্কে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে হয় ঠিক তেমনি যেকোনো আরইআইটি তে বিনিয়োগ করার আগেও সেটার সম্পর্কে ভালো করে বিশ্লেষণ করে নেওয়া প্রয়োজন। বিনিয়োগের আগে প্রধান যে যে বিষয়গুলো দেখে নেওয়া যেতে পারে সেগুলো হলো,

  • ভালো লাভের ও ডিভিডেন্ড দেওয়ার পজিটিভ ট্র্যাক রেকর্ড আছে কিনা।
  • ইউনিটের দামের ইতিহাস বা চার্ট।
  • তাদের পোর্টফোলিওতে বিভিন্ন জায়গার এবং বিভিন্ন ধরনের প্রপার্টি তথা বিভিন্ন ক্ষেত্রের ভাড়াটে বা ক্লায়েন্ট আছে কিনা।
  • কোম্পানিটা অনেক দিনের পুরনো কিনা এবং অভিজ্ঞ ম্যানেজমেন্ট কিনা।
  • অকুপেন্সি রেশিও কিরকম?
  • ওয়েটেড এভারেজ লিজ এক্সপায়ারি কত? মানে প্রপার্টি ফাঁকা হতে কত সময় বাকি? 
  • লোন টু ভ্যালু কত বা ঋণের পরিমাণ কেমন?

শেষ কথা

ভারতবর্ষে এ ধরনের অ্যাসেট ক্লাসের আবির্ভাব নতুন হলেও এক্সপার্টদের মতে আগামী কয়েক বছরে এর বাজার প্রচুর পরিমাণে বাড়বে। ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মাধ্যমে নিজের পোর্টফোলিওতে রিয়েল এস্টেট অ্যাসেট ক্লাস যোগ করে ডাইভারসিফাই করার জন্য এটা খুবই সহজ এবং ভালো একটা উপায়। তবে বিনিয়োগ করার আগে যথেষ্ট পরিমাণ রিসার্চ এবং নিজের ফাইন্যান্সিয়াল এডভাইজারের সাথে কথা বলে নিতে ভুলবেন না।

আজ তাহলে এখানেই শেষ করি। ভালো থাকবেন।

মন্তব্য করুন