শর্ট সেলিং-এর সাতকাহন। যখন শেয়ারের দাম কমলেও লাভ হয়…!

5/5 - (2 জন রেটিং করেছেন)

শেয়ার ট্রেডারদের মধ্যে খুবই পরিচিত একটা টার্ম হচ্ছে শর্ট সেলিং বা শর্টিং। পাতি কথায় এটার মানে হচ্ছে নিজের কাছে শেয়ার না থাকা অবস্থায় আগে শেয়ার বেচে সেল পজিশন নেওয়া এবং পজিশন স্কয়ার অফ বা ক্লোজ করতে পরে শেয়ার কিনে নেওয়া। কিন্তু যেখানে সাধারণভাবে যেকোনো জিনিস আগে কিনলে তবে তার পরে বিক্রি করতে পারা যায়, সেখানে বেচার এই লজিকটা পুরোপুরি উল্টো, তাই না?!

তো শেয়ার ব্যবসার জগতের এই উলটপুরাণ শর্ট সেলিং সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করব আজকের এই নিবন্ধে।

শেয়ার ট্রেডিং-এর লজিক…

শটিং বা শর্ট সেলিং-এর ব্যাপারে জানার আগে শেয়ার ট্রেডিং জিনিসটা আসলে যে কী সেটা নিয়ে একটু আলোচনা করে নেওয়া দরকার। ট্রেড-এর আক্ষরিক বাংলা মানে হচ্ছে লেনদেন বা কেনাবেচা করা। আর সেই অনুযায়ী শেয়ার ট্রেডিং এর সরল বাংলা অর্থ হচ্ছে শেয়ার কেনা-বেচা করা। আর পাঁচটা সাধারণ ব্যবসার মতোই এটাও এক ধরনের ব্যবসা-ই। তফাৎ শুধু এটুকু যে, সাধারণ ব্যবসায় যেখানে কোনো একটা ফিজিক্যাল জিনিস বা সার্ভিস কেনাবেচা করা হয় সেখানে শেয়ার ব্যবসার ক্ষেত্রে শেয়ার (বা অন্য ধরনের সিকিউরিটি) কেনাবেচা হয়।

তবে এই কেনাবেচা বা ব্যবসার কথা এলে সাধারণভাবে আমাদের যে কথাটা মাথায় আসে সেটা হচ্ছে আমরা আগে জিনিস কিনে তারপরে সেটা বেশি দামে বেচে লাভ করি। কিন্তু শেয়ার ব্যবসার ক্ষেত্রে একটা বিশেষ ধরনের লেনদেন করা যেতে পারে যেখানে ইতিমধ্যে নিজের কাছে শেয়ার না থাকলেও সেটা আগে বেচে পরে কিনে লাভ করার সুযোগ পাওয়া যায়। আর সেটাই আমাদের এই নিবন্ধের আলোচনার বিষয়।

বাস্তব জীবনের একটা ‘শর্ট’ গল্প

ইদানিংকালে কিছু কিছু স্মার্টফোন রিলিজ হওয়ার সময় হাইপ তৈরি করার জন্য প্রাথমিকভাবে সেটার প্রকৃত দাম ঘোষণা না করেই অল্প কিছু টাকা দিয়ে সেটার প্রি-বুক করার সুযোগ দেওয়া হয়। আর তারপর ধাপে ধাপে কয়েকদিন ছাড়া ছাড়া এক একটা সেলের দিন নির্ধারণ করে অল্প অল্প স্টকে সেটা বিক্রির স্ট্রাটেজি ধরা হয়। যখন প্রথম সেলের দিনে ফোনটার প্রকৃত দাম প্রকাশ্যে আনা হয় তখন সীমিত সংখ্যাক হ্যান্ডসেট স্টকে থাকার জন্য আগে থেকে যারা প্রি-বুক করে রাখে তারাই সবার আগে ফোনটা কেনার সুযোগ পায়। আর প্রি-বুক না করে থাকলে প্রথম সেলে তড়িঘড়ি ফোনটা পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় থাকেনা বললেই চলে।

তো এমনই একটা ফোন ছিল নাথিং ফোন ১। ফোনটা রিলিজ হওয়ার সময় খুবই হাইপ তৈরি করা হয়েছিল এবং আমিও সেই হাইপে অংশ নিয়ে ফোনটা কেনার জন্য ভীষণভাবে আগ্রহী ছিলাম। মোটামুটি লিক হওয়া তথ্য থেকে প্রত্যাশিত ছিল যে, ফোনটার দাম ৩৩-৩৫ হাজারের মধ্যে হবে। তবে দাম যাই হোক না কেন, আমি সেটা দিতেই প্রস্তুত ছিলাম আর সেজন্যই ২০০০ টাকা দিয়ে প্রি-বুকও করে ফেলেছিলাম।

অন্যদিকে আমার বন্ধু সোমনাথ আমার কাছে ফোনটার ব্যাপারে শুনে আর ওটার আকর্ষণীয় ফিচারগুলো দেখে সেও ওটা কিনবে বলে ঠিক করে ফেলে। কিন্তু ততদিনে প্রি-বুক করার নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ায় অধৈর্য হয়ে ও আমাকে একটা অফার দিয়ে বসে। সর্বোচ্চ প্রত্যাশিত দামের থেকেও ১ হাজার টাকা বেশি অর্থাৎ ৩৬ হাজার টাকা আগে থেকে দিয়ে প্রথম দিনে পাওয়া ফোনটা ও আমার থেকে কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। 

তখন আমি পড়ি কিছুটা দ্বন্দ্বে। প্রত্যাশা অনুযায়ী ফোনটার দাম ৩৩-৩৫ এর মধ্যে হলে এবং সেটা ওকে ছেড়ে দিলে আমার ১-৩ হাজার টাকা লাভ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তবে প্রত্যশা না মিলে যদি ফোনটার দাম আরো বেশি ধার্য হতো সেক্ষেত্রে আমার লাভ কমে যেত বা ওকে ছেড়ে দেওয়াটা অহেতুক হয়ে যেত। তবে প্রকৃত দাম প্রত্যাশিত দামের থেকে আলাদা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন ছিল। আর যদিও সেটা আমিও কিনতে চেয়েছিলাম, একটু দেরি হলেও পরে তো আবার কেনার সুযোগ ছিলই। তাই শেষ পর্যন্ত আমি সোমনাথের ডিলটায় রাজি হয়ে যাই আর সেও কথামতো আমায় আগেই টাকাটা দিয়ে দেয়। 

অতঃপর সেলের দিনে প্রত্যাশা মত দামে অর্থাৎ ৩৩ হাজারেই ফোনটা রিলিজ হয় আর আমি সেটা কেনার পর ওকে দিয়ে দিই। এই পুরো বিষয়টায় একটা আলাদা রকম লেনদেনের ঘটনা ঘটে যায়। লাভের সম্ভাবনা আছে ধরে নিয়ে বিক্রির জিনিস (ফোন) আমার (বিক্রেতা) কাছে না থাকতেই ক্রেতার (সোমনাথ) থেকে টাকা নিয়ে আমি বেচার কাজটা নিস্পত্তি করে দিই। এবং আসলে আমার কত লাভ হতে চলেছে বা আদৌ লাভ হতে চলেছে কিনা সেটা বেচার সময় অজানা থাকে! পরে, অর্থাৎ সেলের দিনে যখন আসলে ফোনটা আমি কিনি, তখনই আমার ৩০০০ টাকা লাভ নির্ধারিত হয়ে যায়। আর বিক্রিত জিনিসের (ফোনটার) ডেলিভারি হয় সবার শেষে!

এমন ধরনের লেনদেনের ঘটনা শেয়ার বাজারেও হয়। আর তার নামই শর্ট সেলিং!

শর্ট সেলিং আসলে কী?

এতক্ষণ পর্যন্ত যা কিছু বললাম সেই অনুযায়ী, আমাদের বাস্তব জীবনে কেনা-বেচা বা লেনদেনের থেকে এই শর্ট সেলিং জিনিসটা একটু আলাদা। সাধারণ ব্যবসার সরল সূত্র অনুযায়ী বাস্তব জীবনে যেকোনো ব্যবসা ক্ষেত্রে কোনো কিছু বিক্রি করতে চাইলে সবার আগে সেটা কিনে নিজের কাছে রাখতে হয়। অতঃপর সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে জিনিসটা বেশি দামে বেচতে পারলেই লাভ পাওয়া যায়। একইভাবে শেয়ার বাজারেও সাধারণভাবে কম দামে শেয়ার কিনে পরে বেশি দামে বেচতে পারলেই লাভ হয়। আর এইভাবে সাধারণ লজিকে আগে শেয়ার কেনাকে বলে লং পজিশন নেওয়া।

আরও পড়ুনঃ  সঠিক স্টক ব্রোকার কিভাবে বেছে নেবেন? ট্রেড-ইনভেস্ট শুরুর আগেই জানুন!

কিন্তু এর উল্টো করলে অর্থাৎ নিজের কাছে শেয়ার না থাকা অবস্থায় আগেই যদি শেয়ার সেল করা হয় তবে তাকে শর্ট পজিশন নেওয়া বলে। এই শর্ট পজিশন ক্লোজ করতে পরে শেয়ার কিনতে হয়। এক্ষেত্রে পজিশন নেওয়ার সময় শেয়ারের দামের থেকে পজিশন ক্লোজ করার সময় দাম কম হলে তবেই লাভ পাওয়া যায়। আর উল্টোটা হলে মানে শর্ট সেল করার পর শেয়ারের দাম বাড়লে লস হয়।

একটা সরল উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ধরে নিই এক্স বলে একটা কোম্পানির শেয়ারের বর্তমান দাম চলছে ৫৫০ টাকা। ওই কোম্পানির একটাও শেয়ার আমার পোর্টফোলিওতে নেই এবং ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার আমার কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও নেই। তবে বিশেষ একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হচ্ছে যে আজ ওটার দাম পড়তে পারে। এই মনে করে আমি ওই এক্স কোম্পানির ১০০ টা শেয়ারের সেল অর্ডার প্লেস করলাম। আর অর্ডারটা এক্সিকিউট হওয়ার পরই আমার শর্ট পজিশন নেওয়া হয়ে গেল।

অতঃপর পজিশন নেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আমার প্রত্যাশা মত ওটার দাম ৩০ টাকা পড়ে গিয়ে ৫২০ টাকা হয়ে গেল। আর তখনই আমি লাভ ঘরে তুলতে একই সংখ্যক অর্থাৎ ১০০টা শেয়ার কেনার জন্য বাই অর্ডার প্লেস করে আমার পজিশন ক্লোজ করলাম। ফলে এই ট্রেডটাতে আমার মোট ৫৫০-৫২০=৩০ ; ৩০*১০০=৩০০০ টাকা লাভ হয়ে গেল। (তবে বাস্তবে এই ট্রেডে লাভের পুরো অঙ্কটা থেকে চার্জ গুলো বাদ যাবে, বিষয়ের সরলতার জন্য এটা উহ্য রাখলাম।) 

এক্ষেত্রে শর্ট পজিশন নেওয়ার পর শেয়ার টার দাম কমেছে বলেই আমি লাভ করতে পেরেছি। যদি পজিশন নেওয়ার পর কোনো কারণে ওটার দাম বেড়ে যেত তাহলে কিন্তু আমার লস হতো। আর একটা কথা হচ্ছে, দ্বিতীয় স্টেপে যখন পজিশন ক্লোজ করার জন্য আমি শেয়ারগুলো কিনেছিলাম তখন কিন্তু আগে নেওয়া আমার শর্ট পজিশনটা ক্লোজ হয়েছিল মাত্র, ওগুলো কিন্তু কখনোই আমার পোর্টফোলিওতে আসেনি।

ট্রেডাররা কখন শর্ট করে (লং বনাম শর্ট)?

এতক্ষণে আশাকরি এটুকু পরিষ্কার যে, সাধারণভাবে শেয়ার কেনা মানে লং পজিশন নেওয়া আর তার উল্টোটা হচ্ছে শর্ট। যেখানে সাধারণভাবে শেয়ারের দাম বাড়ার প্রত্যাশা নিয়ে বা লং টার্ম বিনিয়োগ করতে লং পজিশন নেওয়া হয় সেখানে শেয়ারের দাম কমার প্রত্যাশা নিয়ে শর্ট পজিশন নেওয়া হয়। অর্থাৎ যেখানে লং পজিশন নেওয়ার পর শেয়ারের দাম বাড়লে তবে লাভ হয় সেখানে শর্ট পজিশন নেওয়ার পর শেয়ারের দাম কমলে তবে লাভ হয়। আর দুই ক্ষেত্রেই উল্টোটা হলে হয় লস। 

তাই বাজারে বা কোনো একটা বিশেষ শেয়ারের ক্ষেত্রে যখন নেগেটিভ সেন্টিমেন্ট বিরাজ করে বা বিয়ার ফেজ চলে তখন কম সময়ের মধ্যে দামের ওই পতন কে ব্যবহার করে লাভ করার জন্য ট্রেডাররা শর্ট পজিশন নিয়ে থাকে। আর এই ধরণের পজিশন নেওয়ার উপযুক্ত স্থান, কাল বা পাত্র বোঝার জন্য তারা বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতি, খবর এবং প্রাইস চার্টে তৈরি হওয়া বিবিধ প্যাটার্ন ব্যবহার করে থাকে। 

এই বিষয়টা টেকনিক্যালি কাজ কিভাবে করে?

শর্ট করতে হলে সবার আগে একজন ট্রেডারকে তার ট্রেডিং অ্যাকাউন্টের ড্যাশবোর্ড থেকে শেয়ার বেছে নিয়ে সেল অর্ডার প্লেস করতে হয়। আর অর্ডারটা প্লেস করা মাত্র ট্রেডিং অ্যাকাউন্টের ব্যাকগ্রাউন্ড প্রসেস এক্সচেঞ্জ-কে জানায় যে একজন ট্রেডার ঐ শেয়ারের একটা সেল অর্ডার প্লেস করেছে।

তবে ইতিমধ্যে ডিম্যাট অ্যাকাউন্টে থাকা কোনো শেয়ারের স্বাভাবিক সেল অর্ডার আর এই ধরনের শর্ট সেল অর্ডার গুলোকে এক্সচেঞ্জ কিন্তু আলাদাভাবে দেখেনা। তাদের কাছে একটাই জিনিস ম্যাটার করে সেটা হচ্ছে শেয়ার যখন সেল করা হয়েছে তখন সেটার ডেলিভারী দিতেই হবে। আর যেহেতু সেটেলমেন্ট হয় অর্ডার প্লেস করার পরের দিনে, তাই সেল অর্ডার প্লেস করা মানে পরের দিনের মধ্যে ওই শেয়ারের ডেলিভারি দেওয়ার জন্য ট্রেডারের ডিম্যাটে তার যোগান থাকাটা বাধ্যতামূলক হয়। তবে এই বাধ্যবাধকতার বিষয়টা সম্পর্কে এক্সচেঞ্জ বাজার চালু থাকার সময় জানতে পারেনা, জানতে পারে বাজার বন্ধ হওয়ার পর।

এবার একটা পরিস্থিতির কথা কল্পনা করুন। ধরুন আপনি উপরের উদাহরণের এক্স কোম্পানির শেয়ার ৫৫০ টাকায় শর্ট করেছেন। কিন্তু তারপর ওই শেয়ারের দাম আপনার প্রত্যাশা মত না গিয়ে আরো বেড়ে হয়ে গেছে ৬০০ টাকা। এই অবস্থায় পজিশন ক্লোজ করে আবার কিনে নেওয়া মানে লস হজম করা। তো আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে ঐদিন পজিশন ক্লোজ না করে আরও একটা দিন দেখবেন, এই আশায় যে পরের দিনে শেয়ারটার দাম আবার আপনার প্রত্যাশার দিকে গিয়ে কমে গেলে লাভ নিয়ে বেরিয়ে আসবেন।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাজারের সময় শেষ হওয়ার পরই এক্সচেঞ্জ জেনে যাবে যে আপনি সেল অর্ডার দিয়েছেন এবং আপনাকে পরের দিনের মধ্যে ওই শেয়ারের ডেলিভারি দিতে বাধ্য থাকতে হবে। কিন্তু যেহেতু এটা আপনার শর্ট পজিশন ছিল এবং আপনি সেটা ক্লোজ করেননি (আবার কেনেননি) তাই ওই শেয়ারের ডেলিভারি দেওয়ার মতো কোনো শেয়ার আপনার অ্যাকাউন্টে নেই। তাই আপনি ঐ ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হবেন অর্থাৎ ডিফল্ট করবেন আর এক বিশেষ ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হবে যাকে ‘শর্ট ডেলিভারি’ বলে আখ্যায়িত করা হবে।

এই ধরণের সমস্যার সমাধান করতে এক্সচেঞ্জ নিলাম বাজারের (অকশন মার্কেট) সাহায্য নেয়। ডিফল্ট হওয়া শেয়ারের ঘাটতি মেটাতে এক্সচেঞ্জ ঐ বাজার থেকে থেকে নিলামের মাধ্যমে শেয়ার কিনে হিসেব মেলায় ও বিষয়টার নিস্পত্তি করে। আর ফলস্বরূপ নিলামের গুণকারটা অকশন পেনাল্টি হিসাবে দিতে হয় ট্রেডারকে। আপনি যদি কখনো কোনো কারণে এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েন তাহলে কিন্তু মহা বিপদ। কারণ, যে দামে আপনি শর্ট করেছিলেন অনেকসময় তার ২০%-ও পেনাল্টি হিসাবে কাটা যেতে পারে!

আরও পড়ুনঃ  নিফটি ৫০ (Nifty 50) আসলে কী? এটা না জেনে শেয়ার বাজারে নামাই উচিৎ না!

তবে, এই ধরনের পরিস্থিতি যাতে তৈরিই না হয় সেজন্য শেয়ার বাজারের (ভারতীয়) নিয়ম অনুযায়ী সাধারণ শেয়ারের ক্ষেত্রে শর্ট করতে হলে কেবলমাত্র ইন্ট্রা-ডে অর্ডার হিসাবেই করা যায়। ফলে শর্ট পজিশন নিলে তা সেদিনের মধ্যেই স্কয়ার অফ করে দিতে হয় বা নিজে নিজেই হয়ে যায়, আর তাতে শর্ট ডেলিভারি হয়ে পেনাল্টি হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরিই হয় না।

শেয়ার কেনাবেচার অর্ডার দুই ধরনের হয়, যথাঃ ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি বা লং টার্ম আর ইন্ট্রা-ডে অর্ডার। ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি বা লং টার্ম অর্ডার তখনই ব্যবহার করা হয় যখন শেয়ার কিনে একদিনের বেশি রাখার ইচ্ছা থাকে বা আগে থেকে ডিম্যাটে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে চাওয়া হয়। আর ইন্ট্রা-ডে অর্ডার ব্যবহার করা হয় ইন্ট্রাডে ট্রেডিং করার জন্য। এই ধরণের অর্ডার প্লেস করা মানে একদিনের মধ্যেই স্কয়ার অফ করা (অর্থাৎ কিনলে বেচা বা বেচলে কেনা) বাধ্যতামূলক। আর এটা নিজে না করলে দিনের শেষে সিস্টেম (ব্রোকার) নিজে থেকেই করে দেয়।

তাহলে কি শর্ট পজিশন নেওয়া মানে সেটা কেবলমাত্র একদিনের জন্যই প্রযোজ্য? এটা কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়। সরাসরি শেয়ারের ক্ষেত্রে বা স্পট মার্কেটে এটা সত্যি হলেও ডেরিভেটিভ বা ফিউচার অপশনের দুনিয়ায় কিন্তু শর্ট পজিশন একদিনের বেশিও ধরে রাখা যায়।

একজন ট্রেডার শর্ট সেল করার সময় যা ঘটে তা এক নজরে
১) দাম কমতে পারে এমন শেয়ার ব্রোকারের থেকে ট্রেডার ধার করে;
২) অব্যবহিত পরেই ওই শেয়ার চলতি দামে বাজারে বিক্রি করে;
৩) শেয়ারের দাম কমে গেলে ট্রেডার ওই একই সংখ্যাক শেয়ার বাজার থেকে কম দামে কিনে নেয়;
৪) সবশেষে কেনা শেয়ার ব্রোকারকে ফিরিয়ে দেয় আর চার্জ বাদে বিক্রির দাম ও কেনার দামের তফাৎ টা লাভ হিসাবে পকেটস্থ করে।

ডেরিভেটিভ আর শর্টিং

ডেরিভেটিভ, যথাঃ ফিউচার আর অপশন শেয়ারের থেকে আলাদা হয়। এগুলো বিশেষ কিছু শেয়ার বা ইনডেক্সের ডেরিভেটিভ হয় আর এদের দাম আন্ডারলাইং শেয়ার বা ইনডেক্সকে ফলো করে নির্ধারিত হয়। সরাসরি শেয়ারে শর্ট করার ক্ষেত্রে একদিনের মধ্যে স্কয়ার অফ করার যে সীমাবদ্ধতা থাকে সেটা ডেরিভেটিভের ক্ষেত্রে থাকেনা। আর ডেরিভেটিভ ট্রেড করতে প্রয়োজনীয় মার্জিনের হিসেব-পাতিও অনেকটা আলাদা হয়।

অপশন শর্ট সেলিং

ডেরিভেটিভের মধ্যে অপশন দুই ধরনের হয়, যথাঃ কল আর পুট। আন্ডারলাইং-এর দাম বাড়লে কল অপশনের প্রিমিয়াম বাড়ে আর পুট অপশনের কমে; আর অন্যদিকে আন্ডারলাইং-এর দাম কমলে কল অপশনের প্রিমিয়াম কমে কিন্তু পুট অপশনের বাড়ে। এই দুই ক্ষেত্রেই শর্ট করা মানে কন্ট্রাক্ট রাইট করা বোঝায়। আর ওই কন্ট্রাক্ট যে কেনে তার থেকে অপশন রাইটার প্রিমিয়াম রিসিভ করে। আর যেহেতু এগুলো এক একটা লটে হয় তাই পুরো জিনিসটার ব্যালেন্স বজায় রাখার জন্য অপশন শর্ট করলে ব্রোকার মোটা অঙ্কের মার্জিন ব্লক করে।

যেকোনো ডেরিভেটিভ শেয়ারের মতো অনন্তকাল ধরে থাকা যায়না। ধরণ অনুযায়ী অপশন কন্ট্র্যক্টের একটা বিশেষ এক্সপায়ারি ডেট থাকে। অপশন রাইট বা শর্ট করার পর দুটো বিকল্প থাকে, যথাঃ স্কয়ার অফ করা বা এক্সপায়ারি পর্যন্ত ধরে থাকা। স্কয়ার অফ (বাই) করতে চাইলে অপশন শর্ট করার পর থেকে এক্সপায়ারির মাঝে যেকোনো দিন করা যেতে পারে। আর এক্ষেত্রে শেয়ারের মতোই স্কয়ার অফ করার সময় প্রিমিয়াম কম থাকলে লাভ হয় আর বেশি থাকলে লস।

আর যদি স্কয়ার অফ করার ইচ্ছা না হয় তাহলে এক্সপায়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এক্সপায়ারিতে শেয়ারের দাম বা ইনডেক্সের লেভেল অনুযায়ী আউট অফ দা মানি অপশন কন্ট্রাক্টগুলো মূল্যহীন হয়ে যায় আর রিসিভ করা পুরো প্রিমিয়াম টাই অপশন রাইটারের নিজের কাছে থেকে যায় আর ইন দা মানি অপশন কন্ট্রাক্টগুলো কার্যকরী হয় আর ডেলিভারি বা ক্যাশের মাধ্যমে সেটেল করতে হয়। 

ফিউচার শর্ট সেলিং

অপশন-এর মত ফিউচার-ও এক ধরনের কন্ট্রাক্ট। আর এগুলো বেচা বা শর্ট করা মানে যে কিনল তার সাথে এরকম চুক্তি করা যে, এক্সপায়ারির সময় শেয়ারের দাম যাই হোক বা ইনডেক্স যে লেভেলেই থাকুক না কেন, যে দামে ফিউচার কন্ট্রাক্ট সেল করা হল সেই দামেই শেয়ার/ইনডেক্স কিনতে বা ক্যাশ সেটেল করতে বাধ্য থাকতে হবে। তবে এক্সপায়ারির সময় কিছু চার্জ দিয়ে এই ধরনের কন্ট্রাক্ট রোল ওভার করার বিকল্পও পাওয়া যায়। 

ফিউচারের ক্ষেত্রে লং ও শর্ট দুই ধরনের পজিশন নেওয়া একই রকম। দুই ক্ষেত্রেই একই রকম মার্জিনের প্রয়োজন পড়ে। আর পজিশন নেওয়ার পর চাইলে সেদিন থেকে এক্সপায়ারি পর্যন্ত যেকোনো দিন স্কয়ার অফ করা যেতে পারে। দুই ধরণের পজিশনের তফাৎ হচ্ছে লং পজিশন নেওয়ার পর দাম বাড়লে তবে লাভ হয় আর শর্ট পজিশন নেওয়ার পর দাম কমলে তবে লাভ হয়।

ফিউচার ও অপশন সম্পর্কে বিশদে জানতে হলে নিচের আর্টিকেলটা পড়ে নিতে পারেনঃ
শেয়ার বাজারে ডেরিভেটিভ বা ফিউচার ও অপশন কী?

শর্ট সেলিং-এর সুবিধা

শর্ট সেলিং-এর অনেকগুলো সুবিধা আছে। যেমন,

  • দুদিকে ট্রেডিংঃ শর্ট করা যায় বলেই কোনো শেয়ারের দাম উপরে বা নীচে যে দিকেই যাক না কেন, ট্রেডাররা দুদিকেই ট্রেড করে লাভ করার সুযোগ পায়।
  • লিভারেজঃ শেয়ারের ক্ষেত্রে হোক বা ডেরিভেটিভের ক্ষেত্রে, শর্ট পজিশন নেওয়া মানেই লিভারেজড পজিশন নেওয়া। অর্থাৎ অনেক কম ক্যাপিটাল বা মার্জিন ব্যবহার করেই অনেক বেশি ভ্যালুর সিকিউরিটিতে ট্রেড করা যাওয়ায় কম টাকায় বেশি লাভের সুযোগ পাওয়া যায়।
  • উপরি পাওনাঃ নিজের বিনিয়োগের স্ট্র্যাটেজির মধ্যে শর্ট সেলিং অন্তর্ভুক্ত করলে সাধারণ বিনিয়োগের মাধ্যমে একদিকে যেমন বাজার উপরে ওঠার সাথে লাভ পাওয়া যায় অন্যদিকে তেমন সাময়িক ছোট ছোট কারেকশন গুলোর সময়ও শর্ট করে লাভ ডবল করে নেওয়া যায়।
  • হেজিংঃ বাজারগত ঝুঁকি থেকে পোর্টফলিওকে বাঁচাতে আরো একটা সুরক্ষার লেয়ার দেওয়ার জন্য হেজিং করতে এর ব্যবহার করা যায়।
  • বাজারে লিকুইডিটি সরবরাহঃ শর্ট সেলিং-এর জন্য বাজারে লিকুইডিটি বাড়ে, বিড-আসক স্প্রেড ভালো হয় আর এটা প্রাইস ডিসকভারিতেও সাহায্য করে। 
আরও পড়ুনঃ  ইনভেস্টিং বনাম ট্রেডিং - আলাদা কোথায়? শেয়ার বাজারে কোন পথে যাবেন?

শর্ট সেলিং করার বিপদ

এভাবে ট্রেড করার সাথে কতকগুলো অসুবিধে বা ঝুঁকিও জড়িয়ে আছে। যেমন,

  • ক্ষতির সম্ভাবনা অসীমঃ তাত্ত্বিকভাবে লং পজিশন নিয়ে ট্রেড করা মানে সর্বোচ্চ ক্ষতি হতে পারে ১০০%। কারণ, এক্ষেত্রে শেয়ারের দাম সবথেকে কম ০ হতে পারে, যদিও তার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু শর্ট সেল করা মানে শেয়ারের দাম বাড়লে লস হওয়া। আর শেয়ারের দাম বাড়ার দিকে ধরলে যত খুশি উপরে উঠতে পারে। মানে এক্ষেত্রে বাজার প্রত্যাশার বিপরীতে গেলে ১০০%-এর বেশিও ক্ষতি হতে পারে।
  • লাভের সম্ভাবনা ভীষণভাবে সময়ের উপর নির্ভরশীলঃ শর্ট করে লাভ হবে কি হবেনা সেটা অনেকটাই সময়ের উপর নির্ভর করে। একটা স্টকের দাম কমতে পারে ধরে নিয়ে শর্ট করলেও এবং সেটা ঠিক হলেও অনেক সময় প্রত্যাশিত সময়ের অনেক পরে ঘটনাটা ঘটে। আর ততক্ষন পর্যন্ত পজিশন ধরে রাখা অনেক সময় স্টপলস ছুঁয়ে যাওয়ার ফলে বা ফান্ডের কম পড়ার ফলে সম্ভব হয়না। ফলে এই ধরণের পরিস্থিতিতে গণনা ঠিক হলেও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। আবার অনেক সময় শর্ট করতে এমন দেরী হয়ে যায় যে ততক্ষনে দাম যা পড়ার তা পড়ে গেছে। ফলে সেক্ষেত্রেও লাভের মুখ দেখা হয়না।
  • কম লিকুইডিটির সমস্যাঃ শর্ট সেলিং-এর ক্ষেত্রে অনেক সময় কম লিকুইডিটি সমস্যা তৈরি করে। যে শেয়ারে লিকুইডিটি খুবই কম সেক্ষেত্রে ধার করে শর্ট করার মত শেয়ার ই পাওয়া যায় না, ফলে কখনো কখনো শর্ট করতে চাইলেও করা যায় না। আবার কখনো পজিশন নেওয়ার পর যদি লিকুইডিটি কম হওয়ার জন্য স্কয়ার অফ করা না যায় সেক্ষেত্রে শর্ট ডেলিভারি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
  • মার্জিন শর্টফলঃ শর্ট করার পর শেয়ারের দাম কমার আগে ক্ষনিকের জন্যও যদি বেড়ে যায় তাহলে মার্জিন শর্টফল হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত মার্জিন যোগ করতে অসমর্থ হলে ক্লাইম্যাক্স আসার আগেই ব্রোকার স্বতপ্রণোদিত হয়ে পজিশন স্কয়ার অফ করে দিতে পারে এবং তার জন্য লস হয়ে যেতে পারে।
  • শর্ট স্কুইজঃ অতিরিক্ত শর্ট ইন্টারেস্ট আছে এমন কোনো শেয়ারের ক্ষেত্রে অনেক ট্রেডার একসাথে যখন অনেক শর্ট পজিশন ক্লোজ করে তখন শর্ট স্কুইজের ফলে হঠাৎ করে শেয়ারের দাম কিছুক্ষণের জন্য বেড়ে যেতে পারে আর তেমনটা হলে স্টপলস হিট হয়ে যেতে পারে বা মার্জিন শর্টফল হয়ে পজিশন স্কয়ার অফ হয়ে যেতে পারে। 
  • রেগুলেশনঃ মার্কেট রেগুলেটর শর্ট সেলিং করার অনুমতি দিলেও কখনো কখনো বিশেষ কোনো কারণে কোনো কোনো সেক্টরে বা শেয়ারে শর্ট সেলিং ব্যান করতে পারে। আর তার প্রভাবে হঠাৎ শেয়ারের দাম বেড়ে যেতে পারে বা শর্ট সেলাররা সমস্যায় পড়তে পারে। 
  • ট্রেন্ডের উল্টোদিকে যাওয়ার ঝুঁকিঃ শেয়ারের দাম কম সময়ের বিচারে ওঠানামা করলেও অনেকটা লম্বা সময়ের বিচারে সাধারণত ভালো ভালো শেয়ার এবং ওভারঅল বাজার উপরের দিকেই ওঠে। ফলস্বরূপ শর্ট সেলিং করা মানে সব সময়ই ট্রেন্ডের উল্টোদিকে বাজি ধরা হয়। আর ট্রেন্ডের উল্টোদিকে যাওয়ার ঝুঁকি সবসময়ই থাকে। 
  • শর্ট সেলারদের জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বা লং সেলারদের সমস্যাঃ অনেক সময় একটা কোম্পানির ফান্ডামেন্টালে সেরকম কোনো সমস্যা না থাকলেও শুধুমাত্র শর্ট সেলারদের অতিরিক্ত অ্যাক্টিভিটির জন্য অহেতুক শেয়ারের দাম পড়ে যেতে পারে। আর তার ফলে লং ট্রেডার বা বিনিয়োগকারীদের সমস্যায় পড়তে হতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত শর্ট সেলিং অনেক সময় কোম্পানির রেপুটেশনের উপরেও প্রভাব ফেলতে পারে।

শর্টিং-এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো এক ঝলকে

  • আগে বেচে পরে কিনতে হয়।
  • সেলার যা বেচছে তার মালিক সে হয় না, বেচা শেয়ার অন্য মালিকের থেকে ধার করা হয়।
  • এন্ট্রির থেকে ক্লোজিং প্রাইস কম হলে তবে লাভ হয়।
  • শর্ট করার পর দাম বেড়ে গেলে লস হয়।
  • যে দামে শর্ট করা হয়েছে স্টপলস তার উপরে সেট করতে হয়।
  • স্পট মার্কেটে শুধুমাত্র ইন্ট্রা-ডে হিসেবেই শর্ট করা যায় এবং একদিনের বেশি ক্যারি ফরওয়ার্ড করা যায় না।
  • ডেরিভেটিভ মার্কেটে শর্ট পজিশন একদিনের বেশি ক্যারি ফরওয়ার্ড করা যায়।
  • মার্জিনের প্রয়োজনীয়তা লং ট্রেডের মতোই হয়।

শেষ কথা

উপরের আলোচনা থেকে একটা কথা পরিষ্কার যে, শর্ট সেল করাটা টেকনিকের দিক দিয়ে জলবৎ তরলং হলেও ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে খুব ভালোভাবে না জেনেবুঝে এই পথ ধরা একেবারেই উচিৎ নয়। লং সাইডে ট্রেড করে কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর এবং বাজারের খুঁটিনাটি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার পরেই শর্ট সেলিং করতে যাওয়া উচিত।

তবে এটাকে অ্যাক্টিভ ট্রেডিং-এর অর্ধেক অংশ বলা যেতে পারে। তাই ফুল টাইম ট্রেডার হতে চাইলে লং ট্রেডের মত এটা করার ক্ষেত্রে কম্ফোর্টেবল হওয়াটাও জরুরী।

আজকের পর্ব তাহলে এখানেই শেষ করলাম। কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানানোর অনুরোধ রইল। ভালো থাকবেন। 🙂


সম্পর্কিত পাঠঃ
শেয়ার বাজারের বহুল ব্যবহৃত 40+ টি গুরুত্বপূর্ণ টার্ম বা পরিভাষা ও তাদের অর্থ
ইনভেস্টিং বনাম ট্রেডিং – আলাদা কোথায়? শেয়ার বাজারে কোন পথে যাবেন?

মন্তব্য করুন