টাকা দিয়েই খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির মতো দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত মৌলিক চাহিদাগুলো মেটে। টাকা ছাড়া আজকের দিনে এক পা ও চলা প্রায় অসম্ভবেরই সামিল। এই গুপ্তধন ডট কম-এও সবকিছুই টাকাপয়সা-কে কেন্দ্র করেই। কিন্তু তবুও একটা প্রশ্ন আমার মনে বারে বারে আসেই, যেটা আশা করি আপনাদের মধ্যে অনেকের মনেও আসে। সেটা হচ্ছে, ‘টাকা দিয়ে আর যাই কেনা যাক, সুখ কেনা যায় কি?’
প্রশ্নটা শুনতে সরল হলেও আদপে ওটার উত্তর বড়ই জটিল। আর এই নিবন্ধে আমরা চেষ্টা করব ঐ জটিলতা কাটিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার…
নিরাপত্তা ও সময়ের উপর নিয়ন্ত্রন আসে টাকা থেকেই
কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা থাকলে একটা নিরাপত্তার অনুভূতি আসে। আর এই অনুভূতিটাই হারিয়ে যায় যখন চাকরি চলে যাওয়ার ভয়, ব্যবসা ভালোভাবে না চলা কিংবা চিকিৎসার খরচের চিন্তা কুরে কুরে খায়। এই সমাজে আমাদের জীবনের বেশীরভাগ সমস্যা টাকা না থাকার জন্যই। আর অন্যদিকে শখ পূরণ, ভালো খাওয়া দাওয়া, ভালো বাড়িতে থাকা, গাড়ি চড়া, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদন, এমারজেন্সি খরচ ইত্যাদি সবকিছুই মসৃণভাবে তখনই চলে যখন ব্যাংকে মোটা টাকা গচ্ছিত থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলো তো বটেই এমনকি পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও অর্ধেকের বেশি মানুষ তাদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। আর তার প্রভাব গিয়ে পড়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, সম্পর্ক, ডায়েট, এমনকি তাদের কর্মদক্ষতাতেও। এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই যে নিত্যদিনের খরচ চালানোর মতো এবং তারপরেও কিছু অতিরিক্ত টাকাপয়সা থাকা ভালোভাবে বাঁচার বা ভালো থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক টম রথ তার বই ‘ওয়েলবিইং’ এ বলেছেন, ‘আমরা কীভাবে আমাদের সময় ব্যয় করব তার উপর আরও নিয়ন্ত্রণ দিয়ে অর্থ আমাদের স্বল্পমেয়াদী সুখ বাড়াতে সাহায্য করে।’ উদাহরণ স্বরূপ, কাছে বেশি টাকা থাকলে কর্মক্ষেত্রের কাছে থাকা সম্ভবপর হতে পারে, কর্মক্ষেত্রে কম সময় ব্যয় করে বেশি বেশি সময় পরিবার বা বন্ধুদের দেওয়া যেতে পারে, ইচ্ছেমত কাজ করার জন্য বেশি সময় পাওয়া যেতে পারে ইত্যাদি। এককথায়, টাকাপয়সা কাজে লাগিয়ে আমাদের জীবন অনেক সহজ করে নেওয়া যেতে পারে।
দারিদ্র ভালোভাবে বাঁচার পথে অন্তরায় হয়
“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি…”
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের এক কবিতা থেকে নেওয়া এই কথাটা সর্বৈব সত্যি। যদি টাকাই না থাকে তাহলে ভালোভাবে বাঁচা তো দূর, জীবনটাই তো থমকে যায়… গবেষণায় কম আয়ের সাথে খারাপ স্বাস্থ্য আর স্বল্প আয়ুর সম্পর্ক দেখা গেছে। এবং এটা হওয়াই স্বাভাবিক, তাই না! অর্থাভাবে যেখানে দিন গুজরান করাই কঠিন হয়ে যায় সেখানে পুষ্টিযুক্ত খাবার, ভালো বাসস্থান কিংবা চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়ার কথা ভাবাটাই বিলাসিতার বিষয় হয়ে যায়!
টাকার অভাবের প্রভাব যে শুধুমাত্র একটা মানুষ বা একটা বাড়ির উপর পড়ে তা নয়। যে এলাকার লোকজনের গড় আয় তুলনামূলক ভাবে কম হয় সেই এলাকা তথা সেখানে বসবাসকারীরা ভালো ও নিরাপদ রাস্তাঘাট, পরিষ্কার জল, বড় হাসপাতাল, ভালো স্কুল ইত্যাদি মৌলিক সুবিধাগুলো থেকেও বঞ্চিত হয়।
দারিদ্র্য এমনই এক চেন রিয়াকশন বা ডমিনো এফেক্ট তৈরি করে যাতে দরিদ্রের জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। যেমন ধরুন, গরিব বাড়িতে বাচ্চাদের অনেক কম বয়সে আয় করার রাস্তায় নেমে পড়তে হয় আর তার ফলে তারা যথেষ্ট পরিমাণ শিক্ষার আলোয় আসার সুযোগটাই পায় না। ফলে বেশি মাইনের বড় চাকরি বা বড় কাজ করাও তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা। ফলে জেনারেশন বদলে যায় কিন্তু দারিদ্র্যের অন্ধকার থেকে বেরোনোর রাস্তাটা অধরাই থেকে যায়।
কিন্তু…
উপরের আলোচনার পর টাকা যে ভীষণ প্রয়োজন সেব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকতে পারেনা। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা যে সব সময় সুখী বা ভালো জীবনের কারণ হয় সেটাও কিন্তু নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ ভালো থাকার পরিপন্থী হয়ে ওঠে। এব্যাপারে কয়েকটা তথ্য আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে…
- স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ভারতের পার ক্যাপিটা ইনকাম ৫০০ শতাংশ বেড়েছে [সূত্র], অর্থাৎ মানুষের কেনাকাটা করার ক্ষমতা অনেকখানি বেড়েছে। কিন্তু যত সংখ্যক মানুষ তাদের নিজেদেরকে সন্তুষ্ট বা খুশি মনে করে সেই হারটা কমেছে।
- ভারত তথা পৃথিবীর সমস্ত উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশেই মানুষের গড় আয় বাড়লেও বা জীবনযাত্রার মান উন্নততর হলেও তাদের মধ্যে ডিপ্রেশনের হার ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
- কেউ লটারিতে বড় অঙ্কের টাকা জিতলে সাধারণত দেখা যায় ঐ জয়ের কিছু সময় পরে জেতার বা অর্থ প্রাপ্তির আনন্দটা ফিকে তো হয়ই, এমনকি দেখা যায় লটারি জেতার আগে প্রতিদিনের জীবনে তারা যতটা খুশি থাকত জেতার পরে সেই পরিমাণ খুশিতে ভাটা পড়ে গেছে।
এই ধরনের উদাহরণ ভুরি ভুরি দেওয়া যায়। মোদ্দা কথা হচ্ছে অনেক অনেক টাকা মানেই সব সমস্যা থেকে মুক্তি নয়। বরং অতিরিক্ত টাকা আমাদের জীবনে কিছু সমস্যা তৈরি করে। যেমন,
টাকা আমাদের একা করে দেয়
মানুষ যখন অর্থের কথা ভাবে তখন তারা অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে দেয়। মিনিসোটা ইউনিভার্সিটির একজন গবেষক কিছু পরীক্ষা করেছিলেন যাতে পরিষ্কার দেখা গেছে টাকা মানুষকে সব রকম নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি পেতে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে তারা সব রকম কাজকর্ম একা একা করতে চায়, নতুন পরিচিতি থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চায় এবং অন্যদের সাহায্য করা থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে চায়। ফলে ক্রমশ একাকীত্ব তাদের গ্রাস করে। আর তার সাথে তারা বিস্মৃত হয় সবে মিলে কাজ করার আনন্দ।
অন্যের সাথে তুলনা আমাদের খুশি থাকতে দেয় না
আমরা সবসময়ই অন্যদের সাথে আমাদের নিজেদের আয়ের তুলনা করি আর সেটাই আমাদের মনের মধ্যে অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতি তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, যে মাস গেলে ১ লাখ টাকা আয় করে, সেও তার আয় নিয়ে অসন্তুষ্ট হয় যদি তার বন্ধু দেড় লাখ টাকা আয় করে। অতঃপর তার আয় বেড়ে দেড় লাখ হলে তার খুশি হবার কথা কিন্তু একই সাথে যদি বন্ধুর আয়ও বেড়ে ২ লাখ হয়ে যায় তাহলেই সে খুশি হওয়ার বাদলে অখুশি অনুভব করে।
বেশিরভাগ সময়েই আমাদের আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের অসন্তোষ বা অসন্তুষ্টি আসে আমরা আমাদের চেনা পরিচিত মানুষের আয়ের সাথে পাল্লা দিতে উঠতে সক্ষম হই না বলেই।
বেশি আয় মানে বেশি চাপ আর কম মজা
একটা ব্যাপার কারো কাছেই অজানা নয় যে, উচ্চ আয় আমাদের জীবনে চাপ বাড়িয়ে দেয়। আর এই অতিরিক্ত চাপ একদিকে যেমন জীবনের ছোট ছোট বিষয়গুলো থেকে পাওয়া আনন্দগুলোকে ভুলিয়ে দেয় অন্যদিকে তেমন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন অনেক সময় দুর্বিষহ করে দেয়।
বেশি আয় মানেই বেশি কাজ আর অবসর সময় কম। অন্যভাবে বলতে গেলে বেশি টাকা থাকার সুবিধা গুলো অনেক সময়েই সেটা আয় করতে গিয়ে জীবনের অন্য দিকগুলোতে যে পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তাতে ন্যাস্যাত হয়ে যায়।
বস্তুবাদ আসলে জীবনে অতৃপ্তির কারণ হয়
আমরা অনেক সময়ই ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারি না যে, আসলে কী থেকে আমাদের প্রকৃত আনন্দ আসে। আমাদের সমাজ বারে বারে বলে যে টাকা থেকেই সুখ আসে বা বস্তুবাদেই আনন্দ। আর তাই আমরা সেটাকেই ঠিক ভেবে বসি বা ঐ পথেই গা ভাসিয়ে দিই। কিন্তু এই লজিকের আড়ালে আসলে কি ঘটে চলেছে সেগুলোর উপর গুরুত্ব দিই না বা দিতে চাই না। এই বস্তুবাদ বা মেটেরিয়ালিজম-এর সাথে অনেকগুলো সমস্যা জড়িত। যেমন,
- বস্তুবাদ থেকে পাওয়া সুখ সবসময়ই ক্ষণস্থায়ী। একটা নতুন জিনিস, সেটা ফোন, টিভি, গাড়ি, বাড়ি কিংবা অন্য যাই হোক না কেন, কেনার বা পাওয়ার পর দারুণ আনন্দ হয় বটে কিন্তু সেটা বেশি সময় টেকেনা। কিছুটা সময় পেরাবার পরেই ওই নতুন জিনিসটা আমাদের কাছে পুরানো হয়ে যায়! আবার এই ধরনের কেনাকাটায় বড় অংকের টাকা খরচ হলে সেই খরচ বা ইএমআই এর ভার আমাদের জীবনের প্রকৃত আনন্দের অ্যাক্টিভিটি যেমন বেড়ানো, একসাথে খেতে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলোয় বাদ সাধে।
- আমাদের চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষা গুলো চরিত্রগতভাবে ক্রমশ উর্ধ্বমুখী হতে থাকে। আমাদের আয় যত বাড়ে বা আমরা যত একটার পর একটা দামী জিনিস কেনাকাটা করতে থাকি ততই আমাদের নজর আরো বেশি দামী জিনিসের দিকে পড়তে থাকে। আর অন্তহীন এই আকাঙ্ক্ষার তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে আমরা সব সময়ই আমাদের অতিরিক্ত আয় খরচের খাতে ফেলে দিই বা কখনোও কখনোও ঋণের জালেও জড়িয়ে পড়ি।
- বস্তুবাদ অতিরিক্ত আত্ম-অহংকার, আত্মসম্মান ও সহানুভূতির অভাব ইত্যাদিরও কারণ হয়।
টাকাই শেষ কথা নয়…
অর্থ উপার্জন বা তার চেষ্টা করা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সবসময় এটা নিয়ে উদ্বেগ মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। সবসময় টাকা টাকা করলে এর বাইরের জগৎ-টায় কি আছে সেটা অলক্ষেই রয়ে যাবে। কিন্তু একটু থামলে, একটু অন্যভাবে ভাবলে দেখা যাবে অনেক অনেক টাকা ছাড়াও জীবনটা সুন্দর হতে পারে। আর সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা আমাদের টাকা আর সময় কিভাবে ব্যয় করব সেব্যাপারে সঠিক বিকল্পটা বেছে নিতে পারব। আর এটা পুরোপুরি আমাদেরই হাতে।
প্রচলিত বা বদ্ধমূল ধারণাগুলো বদলানো সহজ নয়। কিন্তু আসল সত্যিটা হচ্ছে জীবনের সব থেকে বড় খুশি গুলো কেনা যায় না। জীবনের আসল তৃপ্তি আসে সুসম্পর্ক থেকে, একটা উদ্দেশ্য ও মানে থেকে, প্রকৃতির সাথে সংসর্গ থেকে এবং অন্যের জন্য কিছু করা থেকে। এগুলো মনে রাখলেই নিজের জন্য উপযুক্ত খুশির রাস্তা খুঁজে নেওয়া যাবে। আর সেই রাস্তায় কিছু টাকার প্রয়োজন পড়লেও শেষ নেই এমন টাকার প্রয়োজন পড়বে না!
এই বলেই আজকের মতো এখানেই শেষ করলাম। ভালো থাকবেন, খুশি থাকবেন। 🙂