যখনই সোনা কেনার প্রয়োজন পড়ে তখনই আমরা খবরের কাগজে কিংবা গুগল-এ সোনার দাম বা গোল্ড রেট কেমন চলছে তা খুঁজে দেখি। বিয়ের গয়না বা বেশি সোনা কেনার হলে আবার অনেক দিন ধরে এই রেটটা অনুসরণ করে এমন দিনে গয়না কিনতে যাওয়ার প্ল্যান করি যেদিন তুলনামুলকভাবে দাম টা কম থাকে।
সোনা চিরকালই ভারতবাসীর হৃদয়ে একটা বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে। গয়না কেনাকাটার নিরিখে ভারতবর্ষ বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয়। তবে ইদানিং ভারতবর্ষে এর বাজার কেবলমাত্র গয়নাতেই আবদ্ধ নেই। গয়না ছাড়াও বিনিয়োগের জন্য ভারতবাসী আজ ফিজিক্যাল ও ডিজিটাল বিভিন্ন উপায়ে সোনা কিনতে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
কিন্তু এত বহুমুখী আগ্রহ-তে কখনও কখনও বাদ সাধে এর দাম। এই মুহূর্তে এর দাম ভরি প্রতি 60000 টাকারও বেশি। প্রথমবার এটা এতটা বেড়েছে। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন কেন এর দাম এই জায়গায় গেল বা কী কী কারনে সোনার দাম এত উপর নিচে হয়?
চলুন সেই উত্তরই আজ খুঁজে দেখা যাক…
#1 চাহিদা ও জোগান
বাজারে সব রকম জিনিসের দাম ওঠানামা করার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে চাহিদা ও জোগান। সোনাও এর ব্যতিক্রম না। এমনিতে দুর্লভ বলেই সব ধাতুর মধ্যে এই ধাতু এত দামী। প্রতিবছর খনি থেকে এই ধাতু যতটা উত্তোলন করা হয় তার পরিমাণ মোটেও বেশি নয়। এই উত্তোলনের পরিমাণ সীমিত হওয়ার জন্য বিভিন্ন কারণে যখন বাজারে এর চাহিদা যোগানের থেকে বেশি হয় তখন এর দাম আরও বাড়ে। আবার একইভাবে কোনো কারনে বাজারের চাহিদা তুলনায় কমে গেলে তখন এর দামও কমতে থাকে।
#2 মুদ্রাস্ফীতি
যখন বাজারে সামগ্রিকভাবে সমস্ত জিনিসপত্রের দাম আগুন হয়ে যায় তখন বলা হয় ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে গেছে। এই মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়া মানে, টাকার ভ্যালু বা বাইং পাওয়ার কমে যাওয়া। কিন্তু টাকার ভ্যালু কমে গেলেও এই হলুদ ধাতুর ভ্যালু কিন্তু কমে না। যায় তাই বিনিয়োগকারীরা এ সময়ে কাছে ক্যাশ রাখার বদলে এটা রাখাই শ্রেয় মনে করে।
তাছাড়া মুদ্রাস্ফীতি যখন বেশি হয় তখন অন্যান্য অনেক ব্যবসার লাভও কমে যায়। তাই অন্যান্য অনেক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে (যেমন শেয়ার বাজারে) এসময়ে বেশি রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তবে সোনায় বিনিয়োগে রিটার্ন পাওয়ার ক্ষেত্রে এধরণের কোনো সমস্যা তৈরি হয়না। তাই এসময়ে বিনিয়োগের বিকল্প হিসাবে মানুষ এটাই বেছে নিতে চায়।
উপরের দুই কারণে বেশি মুদ্রাস্ফীতির সময় সোনার চাহিদা বাড়ে ও তার সাথে এর দামও বাড়ে।
#3 সুদের হার
ব্যাংকের সুদের হারের সাথে সোনার দামের সম্পর্ক ব্যাস্তানুপাতিক। ব্যাংকে সুদের হার যখন কমে যায় তখন ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা থেকে বেশি রিটার্ন পাওয়া যায় না। তখন ব্যাংকের থেকে বেশি রিটার্ন পাওয়ার আশায় অনেকে ব্যাংকে ফিক্স ডিপোজিট করার বদলে সোনায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়। ফলে এর চাহিদা বাড়ে এবং সাথে সাথে বাড়ে এর দাম। একইভাবে ব্যাংকে সুদের হার বাড়লে আবার ঠিক এর উল্টোটা হয়।
#4 গয়নার বাজার
শুরুতেই বলেছি গয়নায় চাহিদার ব্যাপারে ভারতের সোনার বাজার বিশ্বের প্রথম সারিতে আছে। আর এই গয়নার চাহিদা উৎসবের সময় আর বিয়ের মরসুমে শীর্ষে থাকে। ফলে ওই সময় গয়নার চাহিদা বাড়ার জন্য এর দাম বাড়ে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এর দামের তারতম্য হওয়ার জন্য এটা একটা বড় কারণ।
#5 বিদেশী বাজারে চাহিদা
ভারতের মতো বিদেশী বাজারেও কমবেশি গয়নার চাহিদা তো আছেই, তার সাথে সাথে আবার আধুনিক বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেটে, স্টেন্ট ও অন্যান্য মেডিকেল সরঞ্জামে সোনার ব্যবহার হওয়ার জন্য ওইসব জিনিসের চাহিদা বাড়া বা কমার সাথে সাথে সোনার চাহিদাও বাড়ে বা কমে। ফলে তার প্রভাব পৃথিবীব্যাপী এর দামে পড়ে।
এছাড়াও অন্যান্য যেকোনো কারণে বিদেশি বাজারে এর দাম ওঠানামা করলে তার প্রভাব এদেশেও পড়ে।
#6 অনিশ্চয়তা
দেশে বা বিদেশে যেকোনো ধরনের অনিশ্চয়তা (যেমন রাজনৈতিক বা আন্তঃদেশীয় অস্থিরতা, মন্দা, মহামারী, যুদ্ধ ইত্যাদির) তৈরি হলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের নিরাপদ স্বর্গ এই সোনার কাছেই আসে আর যার ফলে এর দাম বাড়ে। সাম্প্রতিককালে এর অস্বাভাবিক দাম বাড়ার জন্য সারা বিশ্বব্যাপী আর্থিক টালমাটাল ও মন্দা সম্পর্কিত যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে প্রধানত সেটাই দায়ী।
#7 সরকারি রিজার্ভ
ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক এবং বেশিরভাগ দেশেরই সেন্ট্রাল ব্যাংকগুলো কারেন্সির পাশাপাশি সোনাও সঞ্চিত রাখে। অর্থনীতির বিবিধ কারণে আলাদা আলাদা সময়ে ব্যাংক দ্বারা এর কেনাবেচার হার আলাদা হয়। তাই যখন কেনার হার বেচার থেকে বেশি হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই এর দাম বাড়ে।
#8 আমদানি শুল্ক
ভারতবর্ষের সোনার খনি প্রায় নেই বললেই চলে। সারা পৃথিবীতে এই ধাতুর যত পরিমাণ উত্তোলন হয় ভারতবর্ষে তার 1%-এর থেকেও কম পাওয়া যায়। তাই ভারতবর্ষে ব্যবহৃত সোনার বেশিরভাগটাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে আমদানি শুল্কের যেকোনো রকমের পরিবর্তন হলে তার প্রভাব এর দামের উপর সরাসরি পড়ে।
#9 ডলারের প্রেক্ষিতে টাকার মান
বিদেশি বাজারে সোনা কেনা বেচা হয় ডলারে। তাই এদেশের আমদানিকারীকে বিদেশে এটা কেনার জন্য সবার আগে ভারতীয় টাকা ডলারে এক্সচেঞ্জ করতে হয়। কিন্তু আমদানি করার পর এদেশে বিক্রি করে দাম পাওয়া যায় ভারতীয় টাকাতেই। ফলে আমদানিকারীদের নিয়মিত টাকাকে ডলারে বা ডলারকে টাকায় এক্সচেঞ্জ করতে হয়। কিন্তু এক ডলারে কত টাকা পাওয়া যাবে সেটা সব সময় পরিবর্তনশীল। তাই আমদানি করার সময় এই টাকা এক্সচেঞ্জ করতে গিয়ে এক্সচেঞ্জ রেটের পরিবর্তনের জন্য যদি কখনো অতিরিক্ত খরচ হয় সেটা আমদানিকারীরা সোনার দাম বাড়ানোর মধ্য দিয়ে উসুল করে।
আবার ডলারের ভ্যালু কমে গেলে তুলনায় ভারতীয় টাকা এবং সাথে অন্যান্য দেশের টাকার ভ্যালু বেড়ে যায়। তখন একই টাকায় আরো বেশি সোনা পাওয়া যায়। যার জন্য এর চাহিদা বাড়ে এবং সঙ্গে দামও বেড়ে যায়।
#10 সোনা উত্তোলনে সমস্যা
বিশ্বে এই হলুদ ধাতু সবথেকে বেশি উত্তোলিত হয় চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া আর পেরুতে। যোগান ও চাহিদার নিয়ম অনুযায়ী এই ধাতু কতটা উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে সেটা এর দামকে সরাসরি ভাবে প্রভাবিত করে।
বিগত কয়েক বছরে এর উত্তোলনের পরিমাণ সেভাবে বাড়েনি। তার উপর কম গভীরতার সহজ জায়গা থেকে বেশিরভাগ সোনা ইতিমধ্যেই উত্তোলন করা হয়ে গেছে। ফলে এর উত্তোলন করতে যখন আরো বেশি খনন করতে হয় তখন সম পরিমাণ উৎপাদন করতে গিয়ে খরচটা আরো বেশি হয়। যার জন্য এর দাম বেড়ে যায়।
একইভাবে নতুন কোনো ভালো খনির সন্ধান পাওয়া গেলে বা উত্তোলনের প্রযুক্তিতে কোনোরকম পরিবর্তনের ফলে উত্তোলন সহজ হয়ে গেলে ফল হয় উল্টো, মানে দাম কমে।
শেষ কথা
সোনার দাম বাড়া কমার কারণ জানতে পেরে আশাকরি আপনি নিজেই এখন কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারবেন কখন কি কারণে এর দাম বেড়েছে বা কমেছে এবং সেই মতো আপনার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে একটু হলেও সুবিধে হবে। আর এবিষয়ে এখানে দেওয়া তথ্য আপনার সামান্যতম কাজে এলেই এই আর্টিকেল তথা এই ব্লগের পিছনে আমার প্রচেষ্টা সফল হবে।
এই বলেই আজকের কথা এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকবেন।