অনেকে তো এটাই ভাবে। আর তুমি? ভাবলে অবাক হবে যে, এই কথাটা এক দিক দিয়ে… সত্যি! কিন্তু আবার অন্য দিক দিয়ে ভাবলে মিথ্যে ও! সত্যি এই অর্থে, যে শেয়ার বাজারে যারা অংশ নেয় তাদের মধ্যে অনেকেই জুয়াড়ি! কিন্তু আবার মিথ্যে-ও কারন শেয়ার বাজারের যাত্রায় যারা সফলতার ধ্বজা উড়িয়েছেন তাঁরা কেউ জুয়াড়ি নন!
শেয়ার বাজার কি?
শেয়ার বাজার জুয়াড়িদের বাজার কিনা সেটা জানতে হলে সবার আগে জানতে হবে শেয়ার বাজার আসলে কি? আর সেটা আমি এখানে আলাদাভাবে বিশদে কিছু বলব না কারন সেই নিয়ে অলরেডি আমার একটা ছোটখাটো আর্টিকেল লেখা হয়ে গেছে। যদি শেয়ার বাজার কি বস্তু তা নিয়ে একটু বিশদে জানতে চাও তাহলে অনুরোধ করবো নিচের লিঙ্কটা চেক করতে।
শেয়ার বাজার আসলে কি? ← (এখানে ট্যাপ করো)
উপরের লিঙ্ক টা চেক করা হল? চলো এবারে জেনে নেওয়া যাক জুয়া এবং জুয়াড়িদের সম্বন্ধে…
জুয়া কি এবং জুয়াড়ি কারা?
বাজি ধরার আরেক নাম জুয়া। আর এই খেলায় সাধারণত বাজি ধরা হয় টাকা দিয়েই। এই খেলাটার ফলাফল লাভ বা ক্ষতি কোনও একটার মাধ্যমে হয়। সাধারনত এই খেলায় 3 টি পক্ষ থাকে। এর মধ্যে দুই পক্ষ খেলায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয় আর তৃতীয় পক্ষ প্রকৃত খেলার অংশ নেয় না কিন্তু খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করে বা নজরদারি চালায় এবং যে ই হারুক বা জিতুক, এই তৃতীয় পক্ষ কিন্তু সব সময়েই জেতে মানে কমিশন লাভ করে। যে দুই পক্ষ খেলায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয় তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে কোনো একটা ‘বিষয়ের’ পক্ষে বা বিপক্ষে বাজি ধরে। যার বাজি মিলে যায় সে বাজির পুরো টাকাটা জিতে যায় আর অন্যজন মানে যার বাজি মেলে না সে পুরো টাকা খোয়ায়। জুয়ার সিম্পল লজিক এটাই। আর যে দুজন প্রত্যক্ষভাবে বাজি ধরতে অংশ নিল তারাই জুয়াড়ি।
কোন ‘বিষয়ে’ বাজি ধরা হবে সেটা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে আমাদের সামনে এসে থাকে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন রূপে জুয়া আমাদের সমাজে বিদ্যমান। মহাভারতের পাশা আর আজকের যুগের ক্যাসিনো জুয়ারই দুই রূপ মাত্র। পাড়ার তাস খেলার আসরে যেমন জুয়া খেলা হয় তেমনই আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি খেলাতেও জুয়াড়িরা তাদের থাবা বসাতে পিছপা হয়না। আর এখন ইন্টারনেটের যুগে, স্মার্টফোনের যুগে কিছু কিছু খেলার অ্যাপ খেলার নামে খেলার পিছনে আসলে জুয়ার আসরই চালায়।
শেয়ার বাজার আর জুয়া
শেয়ার বাজার আর জুয়ার মধ্যে এমনিতে মিল অনেক। সরল নজরে দেখলে জুয়ার মত শেয়ার বাজারেও কোনও শেয়ার বা বাজার (ইনডেক্স, যেমন সেন্সেক্স) বাড়বে নাকি পড়বে সেই বিষয়ে বাজি ধরতে হয় বা সেইমত বাই বা সেল অর্ডার (শর্ট সেল) প্লেস করতে হয়। বাই করার পর যদি শেয়ার বা ইনডেক্স ওঠে তাহলে জয় মানে লাভ পকেটে আর শর্ট সেলের ক্ষেত্রে সেল করার পর যদি শেয়ার বা ইনডেক্স কমে তাহলে লাভ হয়। আর এর অন্যথা হলে হার, মানে ক্ষতি। আর শেয়ার বাজারে ব্রোকার হচ্ছে সেই তৃতীয় পক্ষ মানে প্রথম দুই পক্ষের যে কেউ লাভ বা ক্ষতি করুক না কেন দুই পক্ষের তরফ থেকেই ব্রোকারের কমিশন লাভ নিশ্চিত। সিম্পল, তাই না?
আসলে তা না। শেয়ার বাজার জুয়ার মত তাদের কাছে যারা…
- একটু আনাড়ি
- নবাগত এবং না জেনে বা শিখে নেমে পড়েছে
- টাইম পাস করতে এসেছে
- কম সময়ে কোটিপতি হতে চায়
- অন্য ক্ষেত্রের জুয়াড়ি এবং জুয়ার খেলা হিসাবে শেয়ার বাজারটাকে নির্বাচন করেছে
- শেয়ার বাজারের বাইরের (কিছু) মানুষ
কিন্তু তাদের কাছে এটা জুয়া না যারা…
- শেয়ার বাজারের ব্যাপারে সিরিয়াস।
- এটাকে বিজনেসের নজরে দেখে
- আগে জেনে শিখে বুঝে তারপর নামে
- যারা ইনভেস্ট করে সম্পদ বা Wealth বানাতে চায়
যেকোনো জিনিস ভালো না খারাপ সেটা নির্ভর করে ব্যবহারকারী সেটাকে কিভাবে ব্যবহার করছে তার উপর। কিংবা ব্যবহারের পন্থা জেনে বা না জেনে ব্যবহার করার উপর। উদাহরন স্বরূপ ছুরি রাঁধুনিদের কাছে খুবই ভালো এবং সুবিধের একটা জিনিস। কিন্তু আবার এই ছুরি অনেক অনেক সমাজবিরোধীদের কাছে অন্যায়ে সহযোগী অস্ত্র। ছুরি এমনিতে খুব সুবিধাজনক একটা টুল কিন্তু এটা ধার এবং খুব সাবধানে এবং খুব মনোযোগ সহকারে ব্যবহার করতে হয় নয়তো হাত কেটে আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর সেজন্যই বাচ্ছাদের থেকে আমরা ছুরি দুরেই রাখি।
শেয়ার বাজারও এই ছুরির মতই। দেশের উন্নয়নের রাস্তায়, দেশের ইকোনমিতে শেয়ার বাজার ভীষণ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন কোম্পানির পুঁজির প্রয়োজন মেটায় এই শেয়ার বাজার। আবার তোমার আমার মত সাধারণ মানুষও শেয়ার বাজারের ছুরি ঠিক করে ব্যাবহার করতে পারলে সম্পদ বানানোয় এবং আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনে এটাই মুল ভুমিকা নিতে পারে। কিন্তু এই ছুরি হান্ডেল করতে না জানলে কিন্তু হাত কেটে রক্তপাত হতে পারে মানে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে!
উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, শেয়ার বাজারে পথ চলার রাস্তা দুটোঃ
1. ইনভেস্টিংঃ
ইনভেস্টিং-এ রিস্ক একটু কম এবং জুয়াড়িরা সাধারনত এই খেলাটা (রাস্তাটা) পছন্দ করে না! এই রাস্তায় কোনও কোম্পানির শেয়ার কিনে লম্বা সময়ের জন্য হোল্ড করতে হয়। আর অপেক্ষা করতে হয় বলেই জুয়ার মনোভাব সম্পন্ন মানুষের এটা অপছন্দ। তবে এই রাস্তাতে রিস্ক কম হলেও একেবারে যে নেই তা নয়। যে কোম্পানির শেয়ার কেনা হবে সেই কোম্পানি তাবড় হওয়া চাই, তাদের প্রোডাক্ট পোর্টফোলিও দুর্দান্ত হওয়া চাই, তার ভবিষ্যতে চলার স্পষ্ট রূপরেখা থাকা চাই বা বড় হাওয়ার অসীম সম্ভাবনা থাকা চাই। আর কিছু না দেখে, না জেনে, না বুঝে বা অন্যের কথা শুনে আনাড়ির মত যে সে কোম্পানির শেয়ার কিনে নিলে জুয়ার মত এক্ষেত্রেও বিপর্যয় হতেই পারে। কিন্তু সব কিছু ঠিক ঠাক করার পরও অনেক সময় ইনভেস্ট জলে যেতে পারে, তার জন্য কিছু সিস্টেম অ্যাপ্লাই করতে হয় যেমন ডাইভারসিফিকেশন, অ্যাভারেজিং, স্টপ-লস ইত্যাদি।
মিউচুয়াল ফান্ডে ইনভেস্ট করা মানেও পরোক্ষভাবে আসলে শেয়ার বাজারেই ইনভেস্ট করা আর এতে রিস্ক টা আরও কম। তবে এটাও রিস্ক ছাড়া না। তাই তো সরকারের তরফ থেকে যখন ‘মিউচুয়াল ফান্ড সেহি হ্যায়’ এই অ্যাড টা প্রচার করা হয় তখন ডিসক্লেমার এ বলা হয় ‘Mutual Fund investments are subject to market risks, read all scheme related documents carefully.’
যাইহোক, এবার আসি শেয়ার বাজারের দ্বিতীয় রাস্তার কথায়…
2. ট্রেডিংঃ
জুয়াড়িদের এক্সাইট করে এই ট্রেডিং। জুয়ার সঙ্গে শেয়ার বাজারের এই ট্রেডিং পার্ট টার মিলই সবচেয়ে বেশি। ট্রেডিং-এ ঠিক না ভুল, জিত না হার তার ফলাফল জানা যায় খুব তাড়াতাড়ি। আর তার পর ফিল-গুড হরমোন ‘ডোপামিন’ ক্ষরণ হয় আর জুয়ার সেই বিশেষ ফিলিং টা পাওয়া যায়! কিন্তু এটাকে জুয়ার মত গণ্য করলে জুয়ার মতই ফলাফল হয়। কোনও একদিন জিতলেও অন্য সময় সেই জিতের টাকা খোয়া যায়।
কিন্তু এই ট্রেডিং-কে সিরিয়াসলি নিলে এবং বিজনেসের মত গণ্য করলে অবশ্যই জীবনধারণের একটা রাস্তা হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু কাজ টা মোটেও সহজ না। টেকনিক্যাল অ্যানালিসিস, চার্ট রিডিং, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, পজিশন সাইজিং, স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং, স্টপ-লসের ব্যবহার ইত্যাদি শেখার পরও সবথেকে কঠিন যেটা শেখা সেটা হচ্ছে ইমোশনাল ম্যানেজমেন্ট। তাছাড়া এখানে কিছু পজিটিভ ফল পাওয়ার আগে প্রচুর প্র্যাকটিক্যাল অভ্যেসেরও দরকার পড়ে। দরকার পড়ে অভ্যাস চলাকালীন লস হজম করার মানসিক শক্তি। আর ক্যাপিটাল তো সব সময়েই মাস্ট। তাছাড়া পুরো পদ্ধতিটায় আর্থিক ও মানসিক সাপোর্ট-এর জন্য দরকার অন্য একটা ইনকামের উৎস। সবকিছু মেনে চললে পরিসংখ্যান বলে 1% ট্রেডার সফল হয়! এই 1% টায় ভয়ের কিছু নেই কারন যেকোনো চ্যালেঞ্জিং ক্ষেত্রেই সফলতার হার ওই 1%।
জুয়া তে জয়ের সম্ভাবনা 50% এর কম থাকে। কিন্তু ট্রেডিং-এ উপরে যা যা বললাম সেগুলো মেনে চললে সফলতার হার 50% এর থেকে বাড়িয়ে নেওয়া যায়। তাছাড়া যদি ধরেও নিই যে যেকোনো সময়ে কোনও ট্রেডিং ইন্সট্রুমেন্ট-এর দাম বাড়তে বা কমতে পারে, মানে বাড়া বা কমার সম্ভাবনা 50%। সেটা ধরে নিলেও রিস্ক ম্যানেজমেন্টের সুত্র অনুযায়ী বাজার ফরে গেলে 2X লাভ আর উল্টো দিকে গেলে 1X ক্ষতি (স্টপ লস) স্বীকার করে নেওয়া যায় তাহলেও সফলতার মুখ দেখা সম্ভব।
সুতরাং সিদ্ধান্তে আসাই যায় যে শেয়ার বাজার বা শেয়ার ট্রেডিং জুয়া নয়। ট্রেডিং আসলে এক ধরনের ব্যবসা আর ইনভেস্টিং তো বিনিয়োগের একটা প্রকার মাত্র। আর শেয়ার বাজার যদি জুয়া ই হত তাহলে কি আর শেয়ার বাজার থেকে পৃথিবীব্যাপী তাবড় তাবড় কিছু অতীব ধনী যেমন আমেরিকার ওয়ারেন বাফেট বা আমাদের নিজেদের রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার মত রথী-মহারথীর জন্ম হতে পারত?
দি কনক্লিউশনঃ
সুতরাং যেটা দেখা যাচ্ছে, শেয়ার বাজার জুয়া নাকি জুয়া না সেই মিথ টা ভাঙতে হলে সবার আগে যেটা দরকার সেটা হচ্ছে নলেজ। শেয়ার বাজার একটা সমুদ্রের মত। এখানে জানার, বোঝার, শেখার মত অনেক কিছু আছে। যত জানা যাবে, যত বোঝা যাবে ততই জুয়ার ধোঁয়াশা কেটে সম্ভাবনার নীল আকাশ দৃশ্যমান হবে। আর রিস্ক বা ঝুঁকি যেটুকু আছে সেধরনের একটু রিস্ক জীবনের সব জায়গাতেই থাকে। কিছুটা রিস্ক জীবনে নিতেই হয়। নয়তো জীবন টা খুব বোরিং আর সাধারণ হয়ে যায়! কিছু রিওয়ার্ড পেতে হলে রিস্ক নেওয়াটা মাস্ট! এই যেমন বিয়ের কথাই ধরা যায়! এটা বিশাল বড় একটা রিস্ক কিন্তু সব ঠিক-ঠাক চললে সারা জীবন ধরে রিওয়ার্ডও পাওয়া যায় অনেক! এই ধরনের উদাহরণ ভুরি ভুরি দেওয়া যায়! এব্যাপারে ফেসবুকের স্রষ্টা মার্ক জাকারবার্গের বিখ্যাত একটা উক্তি না বললেই নয়- “জীবনের সব থেকে বড় ঝুঁকি হচ্ছে কোনও রকম ঝুঁকি না নেওয়া!”
শেষ করার আগে…
তাহলে বন্ধু কি সিদ্ধান্তে এলে? শেয়ার বাজারটা একবার চেখে দেখার ইচ্ছে হচ্ছে নাকি? শেয়ার বাজারে ঢোকো আর নাই ঢোকো আমায় আর আমার guptadhan.com কে কিন্তু তোমার মনের বাজারে ঢুকিয়ে রেখো! আজ তাহলে এই পর্যন্তই। আবার কথা হবে পরে। ভালো থেকো। টা টা ।🙂