ক্রেডিট কার্ডের ব্যাপারে 7 টা ভুল ধারণা বা মিথ – না জানলেই বিপদ

5/5 - (5 জন রেটিং করেছেন)

আমরা ছাপোষা চাকুরীজীবী মধ্যবিত্ত বাঙালীরা সাধারণত ক্রেডিট কার্ডের নাম শুনলেই পালাই। কিন্তু ঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে জিনিসটা কিন্তু মোটেও খারাপ না। ছাড়, ক্যাশব্যাক, রিওয়ার্ড পয়েন্ট ও অন্যান্য সুবিধা ছাড়াও এমারজেন্সিতে টাকার দরকার পড়লে এটা যেন ভগবানের আশীর্বাদের মতো কাজ করে। তাছাড়া ক্রেডিট হিস্ট্রির শুরু বা ভালো ক্রেডিট স্কোর তৈরি করা যায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেই। কখনও জেনুইন কারনে লোন নিতে হলে এগুলো কাজে আসে। এত কিছু সত্ত্বেও কিন্তু এই কার্ডের ব্যাপারে অনেকেরই মন ভেজেনা।

এর কারণ হয়তো এই কার্ড নিয়ে আমাদের মনে বাসা করে থাকা কিছু ভুল ধারণা। আর এখানে এমনই 7 টা ভুল ধারনা ভাঙার চেষ্টা করা হবে যাতে আপনি এই কার্ডকে একটু অন্য নজরে দেখতে পারেন।

ভুল ধারণা 1ঃ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা মাত্রই সুদ গুনতে হয়

এটা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। মাসের একটা নির্দিষ্ট দিনে প্রত্যেক ক্রেডিট কার্ডেরই স্টেটমেন্ট জেনারেট হয়। সাধারণত যে তারিখে কার্ড অ্যালট হয় সেটাই ওই কার্ডের স্টেটমেন্ট ডেট হয়। একবার স্টেটমেন্ট জেনারেট হওয়ার পর থেকে পরের স্টেটমেন্ট জেনারেট হওয়া পর্যন্ত যা কিছু ট্রানজাকশন করা হয় সেটা পরের স্টেটমেন্টে বিল হয়। স্টেটমেন্ট জেনারেট হওয়ার পর পেমেন্ট করার জন্য ডিউ ডেট পর্যন্ত আরো কুড়ি দিন এক্সট্রা সময় পাওয়া যায়। আর ওই কুড়ি দিনের মধ্যে যদি বিল মিটিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে কোন সুদ গুনতে হয় না।

মানে ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট করলে ইন্টারেস্ট ফ্রি পিরিয়ড হয় সর্বোচ্চ 30+20=50 দিন পর্যন্ত। স্টেটমেন্ট জেনারেট হওয়ার সাথে সাথেই কার্ড ব্যবহার করলে এবং শেষ দিনে বা ডিউ ডেটে বিল পেমেন্ট করলে সব থেকে বেশি ইন্টারেস্ট ফ্রী পিরিয়ড টা পাওয়া যায়।

আরও পড়ুনঃ  অ্যামাজনে জিনিসপত্রের দাম কখন এবং কত কম হতে পারে কিভাবে বুঝবেন?

তবে এই কার্ড ব্যবহার করে এটিএম থেকে ক্যাশ তুললে সেক্ষেত্রে কিন্তু এই ইন্টারেস্ট ফ্রি পিরিয়ড প্রযোজ্য হয় না। ক্যাশ তোলার সাথে সাথেই সুদ গোনা শুরু হয়ে যায়।

ভুল ধারণা 2ঃ এই কার্ড আপনাকে শপাহলিক করে দেয়

কেনাকাটা করা যার নেশা হয়ে যায় তাকে শপাহলিক বলে। এটা একটা মানসিক ব্যাপার এবং সাধারণত আর্থিকভাবে শৃঙ্খলাহীন মানুষই এই অবস্থার শিকার হন।

ক্রেডিট কার্ড পেমেন্ট করা এবং কেনাকাটা সুবিধাজনক ও রিওয়ার্ডিং করে। কিন্তু কেউ যদি এই কার্ডের অতিরিক্ত ব্যবহার বা অপব্যবহার করেন সেই সমস্যাটা তার নিজের, এই কার্ডের নয়।

আর্থিকভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ হলে এই কার্ড কেন কোনো জিনিসই আপনাকে শপাহলিক করে তুলবে না বা আপনি অনর্থক খরচ করতেও উদ্যত হবেন না। আর আর্থিকভাবে শৃঙ্খলাহীন হলে এই কার্ড না থাকলেও আপনি শপাহলিক হয়ে উঠতে পারেন।

ভুল ধারণা 3ঃ নতুন ক্রেডিট কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করলে ক্রেডিট স্কোর কমে যায়

আপনার যদি কোনোরকম লোনের হিস্ট্রি না থাকে তাহলে তো ক্রেডিট স্কোরের প্রশ্নই আসে না। ক্রেডিট হিস্ট্রির প্রথম উপাদান হিসেবে যদি একটা ক্রেডিট কার্ডের অ্যাপ্লাই করেন তাহলে প্রথমবার আপনার ক্রেডিট স্কোর তৈরি হয় এবং ক্রেডিট হিস্ট্রির সূচনা হয়। এরপর ঠিক ভাবে ব্যবহার করলে ক্রেডিট স্কোর ভালোই থাকে।

প্রথম ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার পর অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে তারপর যদি দ্বিতীয় কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করা হয় সেক্ষেত্রেও ক্রেডিট স্কোরে সেরকম কোনো প্রভাব কিন্তু পড়ে না। যদিও প্রতিবার ক্রেডিট কার্ডের অ্যাপ্লাই করার সাথে সাথে কার্ড কোম্পানিগুলো আপনার ক্রেডিট হিস্ট্রি যাচাই করার জন্য একটা হার্ড এনকোয়ারি করে, এই একটা হার্ড এনকোয়ারির জন্য সাময়িকভাবে ক্রেডিট স্কোরে সামান্য ড্রপ হলেও কয়েক মাস পরে সেটা আবার ঠিক হয়ে যায়।

তাছাড়া লম্বা সময়ের ব্যবধানে নতুন হার্ড এনকোয়ারি হলে বা নতুন ক্রেডিট অ্যাকাউন্ট তৈরি হলে সেটা আসলে ক্রেডিট স্কোরের জন্য ভালোই।

তবে কম সময়ের ব্যবধানে যদি একাধিক কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করা হয় তার বিরূপ প্রভাব ক্রেডিট স্কোরে পড়ে। কম সময়ের ব্যবধানে বারবার হার্ড এনকোয়ারি হলে সেটা বোঝায় আপনার হয়তো কোন আর্থিক সমস্যা তৈরি হয়েছে এবং এতে ক্রেডিট স্কোর কমে যায়। 

আরও পড়ুনঃ  পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড মানেই ভবিষ্যৎ সেট?

ভুল ধারণা 4ঃ একটা কার্ডই যথেষ্ট। একের বেশি ভালো না।

ক্রেডিট কার্ড প্রোভাইডাররা নিজেরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য বিভিন্নরকম ক্রেডিট কার্ড যেমন বের করে তেমনই আবার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে বিভিন্ন কো-ব্র্যান্ডেড কার্ডও বের করে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্নরকম কার্ডে আলাদা আলাদা সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়।

বেশি বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় যদি একাধিক কার্ড থাকে এবং বিভিন্ন রকম ক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত আলাদা আলাদা ক্রেডিট কার্ড আলাদা আলাদা খরচের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

তাছাড়া একাধিক কার্ড ব্যবহার করলে ক্রেডিট ইউটিলাইজেশন রেশিও কমে যায় যেটা ক্রেডিট স্কোর বাড়াতে সাহায্য করে।

তবে একাধিক কার্ড থাকলে প্রত্যেক কার্ড ব্যবহার করতে গিয়ে খরচ বাড়িয়ে ফেলাটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

ভুল ধারণা 5ঃ ক্রেডিট লিমিট বাড়ানো ভালো না

ঠিকভাবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলে এবং সময় মতো বিল মিটিয়ে দিলে সাধারণত কার্ড প্রোভাইডাররা সময় সময়ে ক্রেডিট লিমিট বাড়াবার অফার দেয়।

লিমিট বাড়াবার অফার পেলে সেটা না গ্রহণ করার কোন কারণই নেই। আপনার কোনো প্রয়োজন না থাকলেও এই অফার পাওয়া গেলে সেটা গ্রহণ করে লিমিট বাড়িয়ে নেওয়াই ভালো। ক্রেডিট লিমিট বেশি থাকলে ক্রেডিট ইউটিলাইজেশন রেশিও কম হয় এবং তাতে ক্রেডিট স্কোর বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

তাছাড়া এমার্জেন্সিতে যদি কখনো টাকার দরকার পড়ে, বেশি ক্রেডিট লিমিট থাকলে বেশি সুবিধা পাওয়া যায়।

আর বেশি ক্রেডিট লিমিট থাকলে যদি মনে হয় যে খরচ বেশি হয়ে যেতে পারে বা ফ্রড হতে পারে সেক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডের অ্যাকাউন্ট সেটিংস থেকে ব্যবহার করার লিমিট কমিয়ে রাখা যায়।

ভুল ধারণা 6ঃ পুরানো বা অপ্রয়োজনীয় ক্রেডিট কার্ড ক্যান্সেল করে দেওয়া ভালো

আপনার সব থেকে পুরনো ক্রেডিট কার্ডটা যদি ক্যানসেল করে দেন সেক্ষেত্রে আপনার ক্রেডিট স্কোর কিছুটা কমে যেতে পারে কারন সে ক্ষেত্রে আপনার ক্রেডিট হিস্ট্রির সময়কাল কমে যায়।

তাছাড়া কার্ড ক্যান্সেল করলে আপনার ওভারঅল ক্রেডিট লিমিট কমে যায় এবং তার সাথে বেড়ে যায় আপনার ক্রেডিট ইউটিলাইজেশন রেশিও যেটা ক্রেডিট স্কোরের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

পুরনো কার্ড ব্যবহার না হলে সেটা এমনি ফেলে রাখা বা একদমই অপ্রয়োজনীয় মনে হলে ফিজিক্যালি নষ্ট করে দেওয়া তুলনায় ভালো বিকল্প।

আরও পড়ুনঃ  আধার কার্ড দিয়ে পেমেন্ট? ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ছাড়াই? কিভাবে...?

ভুল ধারণা 7ঃ প্রতিমাসে বিলের নূন্যতম টুকু মেটালেই আর কোনো সমস্যা থাকে না 

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার পর স্টেটমেন্টের নূন্যতম বকেয়া টুকু মিটিয়ে দিয়েই যদি ভাবা হয় বাকিটা পরে মিটিয়ে দিলেই চলবে, তাহলে খুব বড় ভুল করা হবে। নূন্যতম বকেয়া মেটালে, কিছু না দেওয়ার জন্য পেনাল্টি হিসাবে যে টাকাটা কাটে সেটা শুধু দিতে হয়না, আর ডিউ ডেট পেরিয়ে গেলেই ডিউ ডেট থেকে না, ট্রানজেকশনের দিন থেকে ইন্টারেস্ট কাউন্ট করা শুরু হয়ে যায়।

তার ওপর পরের মাসে যে সমস্ত ট্রানজাকশন হয় সেগুলোতেও ইন্টারেস্ট ফ্রি পিরিয়ড থাকে না এবং ট্রানজেকশনের দিন থেকেই ইন্টারেস্ট কাউন্ট হয়।

আর ক্রেডিট কার্ডের ইন্টারেস্ট রেটও খুবই বেশি হয়। বেশি মানে বছরে 40% বা তার থেকেও বেশি হতে পারে।

তাই নূন্যতম টুকু মিটিয়ে এই বিশাল ইন্টারেস্টের বোঝা মাথায় নেওয়ার কোনো মানেই হয়না।

শেষ কথা 

আশা করছি ভুলগুলো ভাঙার পরে এই কার্ডের ক্ষেত্রে আপনার মতামত টা বদলাবে এবং আপনি এই দারুন জিনিসটার সুবিধেগুলো উপভোগ করা থেকে নিজেকে আর বঞ্চিত রাখবেন না।

সম্পর্কিত পাঠঃ
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ২০+ সুবিধা। #৫ আমার সবথেকে প্রিয়…!

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)

ক্রেডিট স্কোর কি?

বিভিন্ন ক্রেডিট ব্যুরো বা ক্রেডিট ইনফরমেশন সংস্থাগুলো (যেমন সিবিল) ঋণ গ্রহীতাদের বিভিন্ন রকম ঋণ এবং ঋণ শোধের তথ্যের উপর ভিত্তি করে 300 থেকে 900 এর মধ্যে একটা নম্বর দেয়। ওই নম্বরটাকেই ক্রেডিট স্কোর বলে।

কিভাবে ক্রেডিট কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করা যায়?

সাধারণত 15 হাজারের বেশি ইনকাম হলে স্বশরীরে ব্যাংকে গিয়ে অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম ফিলাপ করে কিংবা আজকাল ব্যাংক বা বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ড প্রোভাইডারের ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে ক্রেডিট কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করা যায়।

মন্তব্য করুন