টেকনিক্যাল এনালাইসিসের 8 টা মিথ বা ভুল ধারণা। #6 খুব গুরুত্বপূর্ণ

5/5 - (2 জন রেটিং করেছেন)

অনেক ট্রেডার টেকনিক্যাল এনালাইসিসকে ট্রেডিং করার ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে ধরেন। তারা মনে করেন এটাকে একবার ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারলেই লাইফ সেট! অন্যদিকে অনেকের কাছে এটা আবার উপর উপর চার্ট বা কিছু প্যাটার্ন স্টাডি করার একটা পন্থা মাত্র, সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা নিশ্চিত লাভ করার কোনো রাস্তা নয়। টেকনিক্যাল এনালাইসিস সম্পর্কে এই দু ধরনের বিপরীতধর্মী মনোভাবের জন্য এ ব্যাপারে কিছু ভুল ধারণা বাজারে প্রচলিত আছে এবং তার জন্য অনেক সময় এর ব্যবহারও ভুল ভাবে হয়।

ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিসে যেখানে বিবিধ কোম্পানির গুণমানের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেখানে টেকনিক্যাল এনালাইসিসের ক্ষেত্রে কোম্পানিটা কেমন সেটার বদলে অতীত এবং বর্তমানে শেয়ারের দাম, ক্যান্ডেলস্টিক চার্ট প্যাটার্ন, ভল্যুম, বিবিধ ইন্ডিকেটর ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে বাজারের সেন্টিমেন্ট, সাপোর্ট – রেজিস্ট্যান্স এবং ভবিষ্যতে শেয়ারের সম্ভাব্য দাম কেমন হতে পারে সে ব্যাপারে বিশ্লেষণ করা হয়।

এই সম্পর্কে ভুল ধারণা গুলো জন্ম নেয় এখানে অংশগ্রহণকারীদের শেয়ার বাজার সম্পর্কে শিক্ষার ধরণ, মনোভাব এবং অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। যে ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস শিখেছে বা শেয়ারগুলোকে ঐ নজরে দেখতে অভ্যস্ত, কিংবা যখন অনভিজ্ঞ কেউ টেকনিক্যাল এনালাইসিসের ভুল ব্যবহারে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তখন তাদের এব্যাপারে ভীতি বা অনাস্থা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এটা ভুলভাল একটা পদ্ধতি। বিষয়টা সহজ নয়, তবে সঠিক ট্রেনিং এবং যথেষ্ট পরিমাণ অনুশীলনের মাধ্যমে এটা সত্যিই শেয়ার বাজারের ব্রম্ভাস্ত্র হয়ে উঠতে পারে!

চলুন তাহলে এবার জেনে নিই টেকনিক্যাল এনালাইসিস সম্পর্কে ৮ টা মিথ বা প্রচলিত ধারণা যেগুলো আসলে সত্যি নয়…

#1 এটা কেবলমাত্র স্বল্পমেয়াদী ট্রেডিং বা ডে-ট্রেডিং এর জন্য প্রযোজ্য

অনেকরই এই ধারণাটা আছে যে, এটা কেবলমাত্র স্বল্পমেয়াদী বা শর্ট টার্মের ডে-ট্রেডিং বা সুইং ট্রেডিং এর জন্যই উপযুক্ত, লম্বা সময়ের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু আসলে মোটেও এমনটা নয়। বিনিয়োগকারীরা ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস করে বিনিয়োগযোগ্য কোম্পানি খুঁজে নেওয়ার পর সেই শেয়ারে কখন বিনিয়োগ করা সব থেকে বেশি উপযুক্ত হবে সেটা নির্ধারণ করতে এই টেকনিক্যাল এনালাইসিসেরই শরণাপন্ন হন। তাছাড়া বিনিয়োগ শুরু করার পর প্রয়োজন মত আরো কোয়ান্টিটি অ্যাড করা, বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রফিট বুক করা বা বেগতিক অবস্থায় লস মেকিং শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে আসার মতো সিদ্ধান্তও এর মাধ্যমেই নিয়ে থাকেন।

আরও পড়ুনঃ  নিফটি ৫০ (Nifty 50) আসলে কী? এটা না জেনে শেয়ার বাজারে নামাই উচিৎ না!

#2 কেবলমাত্র ছোট রিটেল ট্রেডাররা টেকনিক্যাল এনালাইসিস ব্যবহার করে

কেউ কেউ মনে করে আপনার আমার মতো ছোটো রিটেল ট্রেডাররাই এর ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু আসলে সারা পৃথিবীব্যাপী বিবিধ ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টর যেমন মিউচুয়াল ফান্ড, হেজ ফান্ড, ইন্সুরেন্স কোম্পানি ইত্যাদি তাদের বিশাল ফান্ড ম্যানেজ করার জন্য ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিসের পাশাপাশি টেকনিক্যাল এনালাইসিসেরও সাহায্য নেয় এবং এটা করতে তারা স্পেশালিস্ট টিম নিযুক্ত করে থাকে। তাছাড়া তাদের ব্যবহৃত অ্যালগো এবং হাই ফ্রিকোয়েন্সি ট্রেডিং সিস্টেম বিশেষভাবে এর উপর নির্ভর করেই তৈরি হয়। ৬০% হেজ ফান্ড ট্রেডার তাদের ট্রেড সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে টেকনিক্যাল ফ্যাক্টর গুলো দেখে নিতে অভ্যস্ত।

#3 এতে সফলতার হার খুবই কম

আরও একটা ভুল ধারণা হচ্ছে এর সাহায্যে নেওয়া ট্রেডিং-এর যেকোনো সিদ্ধান্ত বা ট্রেড করার সফলতার হার খুবই কম। কিন্তু যেসমস্ত ট্রেডাররা দশকের পর দশক ধরে সফলভাবে এর সাহায্যে ট্রেড করেছেন তাদের দেখলেই বোঝা যায় এই মিথটাও সত্যি নয়। সত্যি হলে ঐ সমস্ত ট্রেডাররা লম্বা সময় ধরে এতখানি সফলতা অর্জন করতে পারতেন না। ‘মার্কেট উইজার্ডসঃ ইন্টারভিউস উইথ টপ ট্রেডার্স’ বইতে এধরনের বেশ কিছু ট্রেডারের কথা জানা যায়।

#4 টেকনিক্যাল এনালাইসিস শেখা খুবই সহজ

অনলাইনে এবং অফলাইনে টেকনিক্যাল এনালাইসিসের প্রচুর এমন কোর্স পাওয়া যায় যেখানে দাবী করা হয় কোর্স শেষ করা মাত্রই ট্রেডিং-এ সাকসেস পাওয়া যাবে এবং খুব সহজেই ট্রেনিং এর টাকা উঠে আসবে। কিন্তু এই সমস্ত দাবি যারা করে তাদের আসল উদ্দেশ্য লোককে টুপি পরিয়ে নিজেদের পকেট ভরা।

সফল ট্রেডিং এর ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল এনালাইসিস একটা ছোট অংশমাত্র। এভাবে ট্রেডিং করে সফল হতে হলে এর থিওরি শেখার পর লাইভ মার্কেটে সফলভাবে এর প্রয়োগ করার জন্য যেমন প্রচুর অনুশীলন ও অভ্যাস দরকার তেমনই আবার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, লোভ ও ভয়ের অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়গুলোয় পারদর্শিতা ও শৃঙ্খলাও দরকার। আর এত সবকিছু আয়ত্ত করা সহজ কাজ মোটেও নয়। অভিজ্ঞতা তৈরি হতে বা ধারাবাহিকভাবে লাভের মুখ দেখতে সাধারণত বেশির ভাগ ট্রেডারেরই কয়েক বছর লেগে যায়, যদি সে তার আগেই হাল ছেড়ে না দেয়।

আরও পড়ুনঃ  বিনিয়োগে ডাইভারসিফিকেশন কী? কেন? কিভাবে? জানলে বেশ, নয়তো কেস!

#5 এর মাধ্যমে নিখুঁত গণনা করা যায়

অনেক নতুন ট্রেডার টেকনিক্যাল এনালাইসিস থেকে আশা করে যে, এ থেকে পাওয়া সিদ্ধান্ত সব সময়ই নিখুঁত ভাবে লক্ষ্যভেদ করবে। কিন্তু দুঁদে ট্রেডাররা জানেন, এর মাধ্যমে কখনোই ১০০% নিখুঁত সিদ্ধান্তে আসা যায় না। তাঁরা সবসময়ই এর মাধ্যমে যেকোনো শেয়ারের সম্ভাব্য দাম সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তে আসেন সেটা একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টে না হয়ে একটা রেঞ্জের মধ্যে হয়। যেমন ধরুন, ‘ অমুক শেয়ারের দাম আগামী তিন চার মাসের মধ্যে ১০০ থেকে ১১০ এর মধ্যে যেতে পারে।’

তাছাড়া এ ধরনের বিশ্লেষণ গুলোর সবই সম্ভাবনা মাত্র, গ্যারান্টেড নয়। এই বিষয়টা মাথায় রেখে এবং সেই মতো যেকোনো পজিশন নেওয়ার আগে রিস্ক – রিওয়ার্ডের বিষয়টাও হিসেব করে নিতে হয়।

#6 টেকনিক্যাল এনালাইসিসের পজিটিভ ফল পেতে বেশিরভাগ ট্রেডে লাভ করতে হয় 

বেশি সংখ্যক ট্রেডে লাভ করলে তবেই টেকনিক্যাল এনালাইসিস সফল হয় এই ধারণাটাও ভুল। কম সংখ্যক ট্রেডে লাভ করেও এগিয়ে থাকা সম্ভব। ট্রেডিং-এ সফল হওয়ার জন্য সঠিক এনালাইসিস এর পাশাপাশি রিস্ক ম্যানেজমেন্টটাও খুবই জরুরী।

ধরা যাক সৌরভ সবকিছু বিশ্লেষণ করে ৪টে ট্রেড নিল এবং তার মধ্যে ৩টে তে লাভ করল আর অন্যদিকে রিধিমা ৪টের মধ্যে মাত্র একটায় লাভ করল। এক্ষেত্রে মনে হতেই পারে যে সৌরভ এগিয়ে থাকলো। কিন্তু আসলে বিষয়টা একবারেই বিপরীত। লাভের অঙ্কে সৌরভ তিনটে ট্রেডে গড়ে ১০০ টাকা করে মোট ৩০০ টাকা লাভ করল তবে চতুর্থটায় সে ৩০০ টাকা লস করে বসল। ফলে তার নিট লাভ ০ হয়ে গেলো। অন্যদিকে রিধিমার তিনটে ট্রেডে ৫০ টাকা করে মোট ১৫০ টাকা লস হল তবে সে তার উইনিং ট্রেডটায় এক ঝটকায় ২০০ টাকা লাভ করে নিল। সুতরাং ৭৫% ট্রেডে লস করেও সে ওভারঅল ৫০ টাকা লাভে থাকলো। আর দুটো উদাহরণে এতক্ষণে পরিষ্কার যে কম সংখ্যক ট্রেডে লাভ করেও ট্রেডিং এর সফল হওয়া যায়। 

আরও পড়ুনঃ  সবথেকে দামী শেয়ার যাদের এমন 10 ভারতীয় কোম্পানি। #3 জামার ভিতরে...

#7 সব ধরনের বাজারে বা সিকিউরিটিতে টেকনিক্যাল এনালাইসিসের নিয়ম একই

এক ধরনের বাজারে বা সিকিউরিটিতে যেভাবে বা যে ধরনের ইন্ডিকেটর ব্যবহার করে টেকনিক্যাল এনালাইসিস করা হয় সেটা অন্য ধরনের সিকিউরিটিতে বা অন্য বাজারে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। যেমন ইকুইটি, কমোডিটি, ডেরিভেটিভ ইত্যাদি আলাদা আলাদা সিকিউরিটির বৈশিষ্ট্য আলাদা রকম হয়। তাই ঐ সমস্ত রকম সিকিউরিটির বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একই পরিকল্পনা কাজে লাগালে অভিপ্রেত ফলাফল পাওয়া সম্ভব নয়।

#8 এটা শিখতে পারলে রাতারাতি বড়লোক হওয়া যায়

চুরি ডাকাতি বা ঠগবাজি ছাড়া রাতারাতি বড়লোক হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অনেকে মনে করেন একটা কোর্স করে বা কটা বই পড়ে টেকনিক্যাল এনালিসিসের থিওরিটিক্যাল জ্ঞান আহরণ করার পরই বিশাল বিশাল লাভ করে বড়লোক হয়ে যাওয়া যায়। টেকনিক্যাল এনালাইসিস ভালোভাবে রপ্ত করতে পারলে লাভ করা যায় সেটা ঠিকই কিন্তু পুরো বিষয়টা ভালোভাবে বোঝার জন্য সময় লাগে এবং ছোট ছোট পা ফেলতে ফেলতে অল্প অল্প লাভের রাস্তা পেরিয়ে ধীরে ধীরে বড় লাভের দিকে যেতে হয়। এবং পুরো বিষয়টায় অনেকটা সময় ব্যয় হয়। তাই রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে যদি কেউ এই রাস্তায় আসেন তাহলে হতাশা ছাড়া আর কিছুই জুটবে না।

শেষ কথা

শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ বা ট্রেড করার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কিছু টুল ও কনসেপ্ট পাওয়া যায় টেকনিক্যাল এনালাইসিস থেকে। এমন অনেক বিনিয়োগকারী বা ট্রেডার আছেন যারা এর ব্যবহার না করেও সফল হয়েছেন আবার এমনও অনেকে আছেন যারা এখানে তাদের সফলতার ক্রেডিট টেকনিক্যাল এনালাইসিসকেই দিয়েছেন। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ‘যত মত তত পথ’। টেকনিক্যাল এনালাইসিস কোনো ট্রেডার বা ইনভেস্টারের কাজে আসবে কি না সেটা নির্ভর করছে তার জ্ঞান, বোধ, মানসিকতা, ধৈর্য, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর।

আজ তাহলে এখানেই শেষ করি। ভালো থাকবেন।

মন্তব্য করুন