বিদেশী কোম্পানির শেয়ারে কিভাবে বিনিয়োগ করা যেতে পারে?

5/5 - (4 জন রেটিং করেছেন)

এই আর্টিকেলটা পড়তে যে স্মার্টফোনটা ব্যবহার করছেন সেটা অ্যান্ড্রয়েড হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, আর যদি তা না হয় তাহলে নিশ্চিত আইফোন। এই দুটোর মধ্যেই একটা হতে হবে কারণ স্মার্টফোনের বাজারে অ্যান্ড্রয়েড আর আইফোন ছাড়া আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। এদের মধ্যে অ্যান্ড্রয়েড গুগল (নতুন নাম অ্যালফাবেট) কোম্পানির তৈরি আর আইফোন বানায় অ্যাপেল কোম্পানি। মানে স্মার্টফোন, যেটা ছাড়া আমাদের এক মুহূর্তও চলে না সেটা আজকের দিনে এই দুটো কোম্পানি ছাড়া ভাবাই যায় না!

অ্যালফাবেটের আরো কিছু প্রোডাক্ট আমরা প্রতিদিন ব্যবহার করি যেমন গুগল সার্চ, ইউটিউব, জিমেইল, গুগল ম্যাপস, গুগল ক্রোম ইত্যাদি। প্রোডাক্ট গুলোর প্রত্যেকটা তাদের যে যার ক্যাটেগরিতে সেরা। খুবই পরিচিত আরোও একটা কোম্পানি আছে যাকে ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার কথা ভাবাই যায় না। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, কোম্পানিটার নাম ফেসবুক (নতুন নাম মেটা)। এর প্রোডাক্ট ক্যাটালগের মধ্যে ফেসবুক ছাড়াও আরও দুই সেরা জনপ্রিয় অ্যাপ, যথাঃ হোয়াটসঅ্যাপ আর ইনস্টাগ্রামও পড়ে। এছাড়াও এধরণের আরও কয়েকটা উল্লেখযোগ্য নাম হল, পৃথিবীব্যাপী ই-কমার্সের রাজা অ্যামাজন, কম্পিউটার দুনিয়ার মহাসম্রাট মাইক্রোসফট, স্ট্রিমিং কিং নেটফ্লিক্স ইত্যাদি।

উপরে যে সমস্ত কোম্পানিগুলোর কথা বললাম সেগুলোর প্রত্যেকটা পৃথিবীর সেরার সেরা কোম্পানির মধ্যে অন্যতম। এই তালিকাটা এখানেই শেষ নয়, কিন্তু আপাতত স্থানাভাবে অল্পেতেই থামতে হল! যাইহোক, যারা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেন তাদের কাছে এগুলোর প্রত্যেকটা এক একটা রত্ন। বিগত ১-২ দশক ধরে এইসব কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের বিশাল রিটার্নও দিয়েছে। 

কিন্তু ভারতের কোনো বিনিয়োগকারী যদি এগুলোতে বিনিয়োগে ইচ্ছুক হন তাহলে কপাল খারাপ কারণ এনএসি, বিএসি বা ভারতের অন্য কোনো এক্সচেঞ্জেই এগুলো লিস্টেড নয়। কারণ এগুলোর কোনোটাই ভারতীয় নয়, এগুলো বিদেশী (আমেরিকায় অবস্থিত) কোম্পানি।

এধরণের যেকোনো কোম্পানির শেয়ার কিনতে হলে সাধারনভাবে ভারতীয় কোনো শেয়ারের মতো কেনা সম্ভব নয়। কিন্তু ভারতে বসে এধরণের বিদেশী কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা অসম্ভবও নয়। আর কিভাবে সম্ভব তাই নিয়েই আলোচনা করব এই প্রতিবেদনে।

বিদেশী কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করার দরকারটা কী?

ভারতীয় শেয়ার বাজারে লিস্টেড কোম্পানির সংখ্যা ৫০০০-এরও বেশি। তো মনে আসতেই পারে এত কোম্পানি ছেড়ে আবার দেশের বাইরে উঁকিঝুঁকি মারতে যাওয়ার দরকারটা কী? পোর্টফোলিওতে বিদেশী শেয়ার না থাকলে যে পোর্টফোলিও অসম্পূর্ণ, এমনটা বলা যায়না… তবে ব্যাপারটা হচ্ছে ভারতে হাজার হাজার কোম্পানি লিস্টেড থাকলেও আমাদের নজর থাকে সেরার সেরা কয়েকটা নামের দিকেই। আর বিশাল বড় সাইজের ব্লুচিপ কোম্পানিগুলো ঐ ধরণেরই হয়। এগুলোয় বিনিয়োগ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ধরা হয়, কারণ একদিকে এগুলো যেমন মার্কেট লিডার হয় অন্যদিকে এদের কম্পিটিটিভ অ‍্যাডভান্টেজও থাকে।

আরও পড়ুনঃ  শেয়ার বাজারের 5 স্বনামধন্য ট্রেডার - ইনভেস্টার - যারা এখানেই খুঁজে পেয়েছেন গুপ্তধন

দেশের বাইরের কোনো কোম্পানি যদি এধরণের ক্রাইটেরিয়া ম্যাচ করে বা দেশীয় বাজারে উপলব্ধ কোম্পানির থেকেও ভালো ও সম্ভাবনাময় বিকল্প হয় তাহলে সেগুলোতে বিনিয়োগ নয় কেন? তাছাড়া শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ সব সময়েই ঝুঁকিপূর্ণ। এবং সেই ঝুঁকি লাঘব করার একটা রাস্তা হল ডাইভারসিফিকেশন। পোর্টফলিওতে বিদেশী শেয়ার অন্তর্ভুক্ত করা মানে আমেরিকা, ইংল্যন্ড, জাপান ইত্যাদি উন্নত দেশের অপেক্ষাকৃত কম ভোলাটাইল শেয়ারের সাহায্যে অপেক্ষাকৃত বেশী ভোলাটাইল স্বদেশী শেয়ারের অস্থিরতার প্রভাব থেকে নিজের পোর্টফলিওকে রক্ষা করা। মানে এক কথায় বলা যেতে পারে এভাবে নিজের পোর্টফোলিওতে ভৌগলিক বৈচিত্র্য (জিওগ্রাফিক্যাল ডাইভারসিফিকেশন) আনা যেতে পারে। উপরন্তু শেয়ারের দাম বাড়ার পাশাপাশি ডলারের ভ্যালু বাড়ার সাথে সাথে এধরণের বিনিয়োগ থেকে অতিরিক্ত লাভও পাওয়া যায়।

কিভাবে বিদেশী শেয়ার কেনা যাবে?

বিদেশী কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করার প্রধান রাস্তা দুটোঃ

  1. সরাসরি শেয়ার কেনার মাধ্যমে বিনিয়োগ
  2. পরোক্ষভাবে মিউচুয়াল ফান্ড বা ইটিএফ-এর মাধ্যমে বিনিয়োগ

#1 সরাসরি শেয়ার কেনা

সরাসরি বিদেশী শেয়ার কিনতে হলে ভারতীয় কোনো ব্রোকারের সাধারণ ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট দিয়ে সম্ভব নয়। তো এই সমস্যার সমাধান দুটো। যথাঃ

ক) দেশীয় ব্রোকারের কাছে ওভারসিজ ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট খোলা

অনেক ভারতীয় ব্রোকার বিদেশী ব্রোকারের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তাদের মাধ্যমে বিদেশী বাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দেয়। ভারতের বড় বড় ট্র্যাডিশনাল ব্রোকার যেমন আইসিআইসিআই সিকিউরিটিস, এইচডিএফসি সিকিউরিটিস ইত্যাদির কাছে এধরণের গ্লোবাল ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট খোলা যায়।

দেশীয় ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খোলার মতোই এক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় সমস্ত কাগজপত্র সহযোগে আবেদন করতে হয়। অ্যাকাউন্ট খোলা হয়ে গেলে তার পরের কাজটা দেশীয় শেয়ার কেনার মতোই। তবে সরকারি নিয়মনীতি অনুযায়ী এক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। আর দেশীয় ডিম্যাটের তুলনায় অনেক বেশী অ্যাকাউন্ট খোলার চার্জ থেকে শুরু করে হাই ব্রোকারেজ, কারেন্সি কনভার্সন চার্জ ইত্যাদি মিলিয়ে এক্ষেত্রে খরচটাও অনেক বেশী হয়।

আরও পড়ুনঃ  শেয়ার ট্রেডিং শুরু করার ইচ্ছে? এগুলো না জেনে নিলে খুব হোঁচট খেতে হবে!

খ) বিদেশী ব্রোকারের কাছে ওভারসিজ ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট খোলা

ভারতে যে সমস্ত বিদেশী ব্রোকারের উপস্থিতি আছে তাদের কাছেও সরাসরি ওভারসিজ ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট খোলা যেতে পারে। এধরণের কয়েকটা ব্রোকার হল ইন্টারঅ্যাক্টিভ ব্রোকার, স্যাকশো, ট্রেডস্টেশন ইত্যাদি।

তবে এধরণের বিবিধ ব্রোকারের চার্জ স্ট্রাকচারে অনেক তফাৎ থাকে। তাই অ্যাকাউন্ট খোলার আগে এসব গুলো ভালোভাবে দেখে ও বুঝে নেওয়া উচিত।

#2 পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ

নিজে সরাসরি শেয়ার না কিনে পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ করতে চাইলে দুটো বিকল্প আছে, যথাঃ ইন্টারন্যাশনাল মিউচুয়াল ফান্ড অথবা ইটিএফ-এর মাধ্যমে বিনিয়োগ। এধরণের ইন্টারন্যাশনাল ফান্ডগুলো এদেশের বিবিধ ইকুইটি ফান্ডের মতই। এগুলো থিম অনুযায়ী বিভিন্ন বিদেশী শেয়ারে বিনিয়োগ করে। এগুলোতে অন্যান্য আর পাঁচটা দেশীয় মিউচুয়াল ফান্ডের মতই ভারতীয় টাকাতেই বিনিয়োগ করা যায় এবং বিনিয়োগের অংক অনুযায়ী ইউনিট পাওয়া যায়।

বিঃ দ্রঃ বিদেশী শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ফান্ডগুলোর উপর সেবির সাম্প্রতিক বিধি-নিষেধের ফলে সব ফান্ডে এই মুহূর্তে নতুন করে বিনিয়োগ সম্ভব নাও হতে পারে। তবে ডিম্যাট থেকে ইটিএফ-এর ইউনিট কেনায় যদিও কোনো বাধা নেই, কিন্তু সেক্ষেত্রে যেহেতু এই ইউনিটগুলো আগের কোনো হোল্ডারের থেকে কিনতে হয়, তাই বাজারে চাহিদা অনুযায়ী এগুলোর দাম যা হওয়া উচিৎ তার থেকে অনেক বেশী-ও হতে পারে।

বিভিন্ন ধরণের ইন্টারন্যাশনাল মিউচুয়াল ফান্ড

এধরণের ফান্ডগুলোকে বিনিয়োগের ধরণ অনুযায়ী চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথাঃ

  • #১ অ্যাক্টিভ ইন্টারন্যাশনাল ফান্ডগুলোয় থিম অনুযায়ী ফান্ড ম্যানেজাররা সরাসরি বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে। আইসিআইসিআই প্রুডেনশিয়াল ইউএস ব্লুচিপ ইকুইটি ফান্ড এর একটা উদাহরণ। এই ফান্ডটার নাম থেকে যা বোঝা যাচ্ছে সেটা হচ্ছে এই ফান্ডে আমেরিকার বিভিন্ন ব্লু চিপ কোম্পানিতে সরাসরি বিনিয়োগ করা হয়।
  • #২ প্যাসিভ ফান্ডে কোনো একটা ইনডেক্স ফলো করে সেই অনুযায়ী বিনিয়োগ করা হয়। এধরণের একটা ফান্ড হল মতিলাল অসওয়াল এস অ্যান্ড পি ৫০০ ইনডেক্স ফান্ড।
  • #৩ কিছু কিছু হাইব্রিড ফান্ডে দেশীয় শেয়ারের পাশাপাশি বিদেশী শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়। যেমন পরাগ পারিখ ফ্লেক্সি ক্যাপ ফান্ড, ডিএসপি ভ্যালু ফান্ড বা অ্যাক্সিস গ্রোথ অপরচুনিটিস ফান্ডে ন্যূনতম ৬৫% দেশীয় শেয়ার বিনিয়োগ করার পর বাকিটা করা হয় বিদেশী শেয়ারে।
  • #৪ কিছু ফান্ডকে বলা হয় ফান্ড অফ ফান্ড। এগুলো আবার বিভিন্ন বিদেশী ফান্ডে বিনিয়োগ করে। যেমনঃ আইসিআইসিআই প্রুডেনশিয়াল গ্লোবাল স্টেবল ইকুইটি ফান্ড অফ ফান্ড, আদিত্য বিড়লা সান লাইফ গ্লোবাল এক্সিলেন্স ইকুইটি ফান্ড অফ ফান্ড, মতিলাল অশোয়াল ন্যাসড্যাক ১০০ ফান্ড অফ ফান্ড ইত্যাদি।
আরও পড়ুনঃ  বিভিন্ন ধরণের বিনিয়োগে কত ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স দিতে হয়...?

ইন্টারন্যাশনাল ইটিএফ

সাধারণ মিউচুয়াল ফান্ড আর ইটিএফ-এর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ইটিএফ-গুলো এক্সচেঞ্জে শেয়ারের মতো ট্রেড হয় এবং সাধারণ ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট থাকলেই শেয়ারের মতো এর ইউনিট কেনাবেচা করা যায়। কয়েকটা উল্লেখযোগ্য ইন্টারন্যাশনাল ইটিএফ হল,

ফ্যাঙ্গ প্লাস (FANG+) ইনডেক্স - প্রথমেই যে কোম্পানিগুলোর নাম নিয়ে শুরু করেছিলাম সেই বাঘা বাঘা টেকনোলজি কোম্পানিগুলোকে একসাথে বলে ফ্যাঙ্গ [FANG বা FAANG → F-Facebook, A-Amazon, A-Apple, N-Netflix, G-Google]। এই ৫টা কোম্পানির সাথে আরও ৫টা হেভিওয়েট কোম্পানি যথাঃ মাইক্রোসফট, টেসলা, এনভিডিয়া, বাইডু ও আলিবাবা কে যুক্ত করে ফ্যাঙ্গ প্লাস ইনডেক্সটা তৈরি হয়েছে।

শেষ কথা

তাহলে বিদেশী শেয়ারে বিনিয়োগ অতটাও জটিল নয়, কি বলেন?! তাছাড়া আজকের দিনে গ্রো, ইন্ডমানি ইত্যাদি ব্রোকারের স্মার্টফোন অ্যাপের সাহায্যে কাজটা হয়ে যায় জলবৎ তরলং!

আজ তাহলে এখানেই শেষ করি। ভালো থাকবেন।

দাবিত্যাগঃ এখানে যেসমস্ত ফান্ডের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো বিনিয়োগের কোনো রেকমেন্ডেশন নয়। বিষয়টা বোঝানোর উদ্দেশ্যে উদাহরণ হিসাবে নামগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)

বিদেশী শেয়ারে বিনিয়োগের সব থেকে সহজ উপায় কী?

সব থেকে সহজ এবং সস্তার উপায় হচ্ছে ইটিএফ-এর মাধ্যমে বিনিয়োগ। এই উপায়ে সাধারণ ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট থেকে ১০০ টাকারও কমে বিনিয়োগ সম্ভব।

গুগল কোম্পানির একটা শেয়ারের দাম কত?

বর্তমানে গুগলের পেরেন্ট কোম্পানির নাম অ্যালফাবেট। সাম্প্রতিক শেয়ারের দাম অনুযায়ী অ্যালফাবেটের একটা শেয়ার কিনতে এই মুহূর্তে খরচ পড়বে ১০ হাজার টাকার কিছু বেশি। তবে চাইলে এর একটা শেয়ারের ভগ্নাংশেও বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

মন্তব্য করুন