জীবন মানে অগণিত সমস্যা আর তার সমাধানে সফল কিংবা অসফল হওয়ার কাহিনী। যে তার জীবনে যত বেশি সমস্যার সমাধানে সক্ষম হয় সে-ই জীবন যুদ্ধে তত বেশি সফলতা লাভ করে। আজ আমাদের আলোচনার বিষয় সংসারের উপার্জনকারীর কিছু সমস্যা ও তার সমাধান…।
যারা আয় করে তাদের কাঁধে সংসারের ব্যয়ভার বহন করার গুরুদায়িত্ব অর্পিত থাকে। একটা পরিবারের বর্তমান ও ভবিষ্যতের পরিস্থিতি কেমন হবে সেটা ওই আয়ের ওপরই নির্ভর করে। তাই উপার্জনকারীদের সব সময়েই আয় এবং সম্পদ বাড়িয়ে সংসারে আরও সচ্ছলতা ও ‘আচ্ছে দিন’ আনার চেষ্টায় লেগে থাকতে হয়। আর এই সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে আয়ের পাশাপাশি বিবিধ উপায়ে বিনিয়োগ-ও করতে হয়।
কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আবার একটা বড় সমস্যা হল মুদ্রাস্ফীতি। বিনিয়োগে রিটার্নের হার দিয়ে মুদ্রাস্ফীতির হারকে হারাতে না পারলে নির্দিষ্ট সময়ের পর বিনিয়োগের টাকা যেটুকু বাড়ে সেই সময়ের মধ্যে জিনিসপত্রের দাম ততটা বা তার থেকে বেশি বেড়ে যায়, ফলে রিটার্নের অংকটা নাল এন্ড ভয়েড বা অকার্যকর হয়ে যায়। তাই আদপে রিটার্নের ফলটা পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতিসাধনে কোনো কাজেই আসেনা।
মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা সমাধানের উপায় হচ্ছে শেয়ার বাজারে লম্বা সময়ের জন্য ঠিকঠাক উপায়ে বিনিয়োগ করা। কিন্ত একটা সাধারণ মানুষের পক্ষে সরাসরি সঠিক উপায়ে এখানে বিনিয়োগ করাটা আবার আরও একটা সমস্যা। তবে এই সমস্যার সহজ সমাধান মিউচুয়াল ফান্ডে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী এসআইপি করা। এর মাধ্যমে বিনিয়োগ করা মানে পেশাদারদের হাতে টাকা তুলে দেওয়া যাতে তারা আমাদের হয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে মুদ্রাস্ফীতিকে হারানোর মতো রিটার্ন এনে দিতে পারে।
কিন্তু এতে কি সমস্যা পুরোপুরি মিটবে? গ্যারান্টি সহ পরিবারের আচ্ছে দিনের ব্যবস্থা কি হবে? আসলে আমি বলতে চাইছি মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা তো যাবে আয় থেকে। কিন্তু যদি আয় করার লোকটাই না থাকে?! কঠিন হলেও বাস্তব হচ্ছে আমাদের জীবন খুবই অনিশ্চিত। কখন কার কি যে হয়ে যায় তা কেউ জানেনা। অনেক কিছু পরিকল্পনা করলেও মাঝপথে হঠাৎ ফুটুর ফুস হয়ে গেলেই সব প্ল্যান চপাট হয়ে যায় আর পরিবারের সকলে পড়ে অথৈ জলে… তাই উপার্জনকারীর অবর্তমানে পরিবারের সকলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার সমস্যা মেটাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি জীবনবীমাও করতে হয়।
এক্ষেত্রে আবার সমস্যা হচ্ছে ‘কেবলমাত্র জীবনবীমার’ পলিসিগুলোয় না মরলে প্রিমিয়ামের টাকাটা পুরোটাই জলে যায় আর ‘সাধারণ সঞ্চয়সহ জীবনবীমার’ পলিসিগুলোয় রিটার্নের হার খুবই খারাপ হয়। এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে বীমা ও বিনিয়োগ সহ এক ধরণের ২ ইন ১ জীবনবীমা প্ল্যান, যার নাম ‘ইউলিপ’। আর এই ইউলিপ সম্বন্ধেই বিষদে জানতে পারবেন এই নিবন্ধে।
ইউলিপ কী?
ইউলিপ (ULIP)-এর পুরো কথা ইউনিট লিঙ্কড ইন্সুরেন্স প্ল্যান। এটা আসলে এক ধরণের হাইব্রিড জীবনবীমা পলিসি যাতে প্রিমিয়াম দেওয়ার মাধ্যমে জীবনবীমার সুরক্ষাও পাওয়া যায় আবার মিউচুয়াল ফান্ডের মত শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের সুবিধাও পাওয়া যায়। মানে এক তিরে দুই লক্ষ্যভেদ হয়!
ইউলিপ যোগায় লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলো। তাই এই প্ল্যান কেনার ক্ষেত্রে প্রদেয় অর্থটাকে প্রিমিয়াম বলে। এতে দেওয়া প্রিমিয়ামের একটা অংশ যায় জীবনবীমার খাতে, আর একটা অংশ যায় বাজার সংক্রান্ত সিকিউরিটিতে বিনিয়োগের ফান্ডে। বিনিয়োগের অংশটুকুর উপর ভিত্তি করে এক্ষেত্রে মিউচুয়াল ফান্ডের মতোই পলিসিহোল্ডারের নামে ফান্ডের ইউনিট বরাদ্দ করা হয়। মিউচুয়াল ফান্ডের মতই ঐ ইউনিটের নেট অ্যাসেট ভ্যালু বা এনএভি থাকে যেটা প্রতিদিনের হিসাবে গণনা করা হয়। এই ইউনিট বাজারের সাথে লিঙ্কড থাকে বলে বাজারের ওঠাপড়ার সাথে সাথেই এর এনএভি-র ও ওঠাপড়া হয়।
মিউচুয়াল ফান্ডের মতোই এক্ষেত্রেও ফান্ড ম্যানেজ করে পেশাদার ফান্ড ম্যানেজাররা।
ইউলিপের সুবিধা
#১ খুশিমতো বীমার বিকল্প বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেয়
- পছন্দমত বীমার অঙ্ক বেছে নেওয়া যায়। যত বেশি টাকার পলিসি কেনা হয় বীমার অঙ্কও তত বেশি হয়।
- পলিসির উপর ভিত্তি করে জীবনবীমার অঙ্ক আলাদা হয়, তবে সাধারণত বেশীরভাগ ইউলিপের ক্ষেত্রে বার্ষিক প্রিমিয়ামের ১০ গুন অঙ্কের বীমার সুবিধা পাওয়া যায়। কিছু কিছু পলিসিতে তো প্রিমিয়ামের ৪০ গুন বা তার থেকে বেশি অঙ্কের বীমাও হয়।
#২ বিনিয়োগের ধরণ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেয়
- মিউচুয়াল ফান্ডের মতোই ইউলিপেও ফান্ড ৩ ধরণের হতে পারে যথাঃ ইকুইটি, ডেট (Debt) ও হাইব্রিড।
- বিনিয়োগের লক্ষ্য ও ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতার উপর ভিত্তি করে এর মধ্যে যেকোনো একটা ফান্ড বেছে নিতে হয়।
#৩ ফ্লেক্সিবিলিটি আছে
- বাজারের পরিস্থিতি অনুযায়ী বিনিয়োগে রিটার্নের সম্ভাবনা বাড়াতে অথবা ঝুঁকি কমাতে পলিসির মাঝপথে ইচ্ছেমত ফান্ডের ধরণের পরিবর্তন বা এক ধরণের ফান্ড থেকে অন্য ধরণের ফান্ডে সুইচ করা যায়।
- পলিসির ম্যাচুরিটিতে একসাথে রিটার্ন সহ পুরো বিনিয়োগের টাকা অথবা নিয়মিত বার্ষিক প্রদান হিসাবেও ফেরত নেওয়া যায়।
#৪ লিকুইডিটি সন্তোষজনক
- জীবনবীমা মানেই লম্বা সময়ের পরিকল্পনা। তাই এক্ষেত্রে ৫ বছরের লক-ইন পিরিয়ড থাকে।
- ঐ সময়ের পর চাইলে ম্যাচুরিটির আগেও আংশিক টাকা তুলে নেওয়া যায়।
#৫ ট্যাক্সের সুবিধা
- বছরে দেড় লাখ পর্যন্ত দেয় প্রিমিয়াম ইনকাম ট্যাক্সের ৮০সি সেকশনে ডিডাকশনের আওতায় পড়ে।
- বিনিয়োগের শেষে পাওয়া রিটার্ন বা পরিবারের ডেথ বেনিফিট-ও ইনকাম ট্যাক্সের সেকশন ১০(১০ডি)-র আওতায় ট্যাক্স ফ্রি হয়।
চার্জ
এইযে ইউলিপে এত্ত এত্ত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে তার জন্য ইন্সুরেন্স কোম্পানি চার্জ তো নেবেই তাই না! এক্ষেত্রে যেসমস্ত বিভিন্ন ধরণের চার্জ কাটে সেগুলো হল,
- প্রিমিয়াম অ্যালোকেশন চার্জ – প্রিমিয়ামের টাকা বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ করার জন্য নেওয়া হয়।
- ফান্ড ম্যানেজমেন্ট চার্জ – ইউলিপের ইনভেস্টমেন্ট পোর্টফোলিও ম্যানেজ করার জন্য নেওয়া হয়।
- মর্টালিটি চার্জ – লাইফ কভার দেওয়ার জন্য কাটা হয়।
- পলিসি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চার্জ – পলিসি রেকর্ড মেন্টেন করতে এবং সার্ভিস প্রোভাইড করতে ইন্সুরেন্স কোম্পানি এটা নেয়।
- সারেন্ডার চার্জ – লক-ইন পিরিয়ড শেষ হওয়ার আগে পলিসি সারেন্ডার করলে এই চার্জটা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
- সুইচিং চার্জ – ফান্ড পরিবর্তন করলে এটা দিতে হয়।
- পার্শিয়াল উইথড্রয়াল চার্জ – ম্যাচুরিটির আগে কিছু টাকা তুলে নিতে চাইলে এটা দিতে হয়।
সবকটা চার্জ সমস্ত পলিসির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। কারণ কিছু কিছু পলিসিতে কিছু চার্জ নেওয়া হয় না। এছাড়া কি হারে চার্জ নেওয়া হবে সেটাও পলিসি ভেদে আলাদা হয়।
বিভিন্ন ধরণের ইউলিপ প্ল্যান
বিভিন্ন ধরনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে ইউলিপ প্ল্যান বিভিন্ন ধরনের হয়। যেমন,
- অবসরের জন্য ইউলিপ – এক্ষেত্রে চাকরিজীবন চলাকালীন প্রিমিয়াম দিয়ে যেতে হয় আর অবসরের পরে অ্যানুইটি হিসাবে ফেরত পাওয়া যায়।
- সম্পদ তৈরির জন্য ইউলিপ – সাধারণত কম বয়সীরা এই প্ল্যান বেছে নেয়। ভবিষ্যতের বিবিধ লক্ষ্য অনুযায়ী ফান্ডের জোগান দিতে এই ধরণের ইউলিপ কাজে আসে।
- সন্তানের শিক্ষার জন্য ইউলিপ – সন্তানের শিক্ষায় যাতে কোনো বাধা না আসে তার জন্য এই প্ল্যানের মাধ্যমে তার শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন সময়ে ছোটো ছোটো খণ্ডে রিটার্নের টাকা পাওয়া যায়।
নিজের জন্য সঠিক ইউলিপ বেছে নেওয়ার আগে যে বিষয়গুলোর উপর খেয়াল রাখা জরুরী
- নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য – সবার আগে প্ল্যান কেনার পিছনে নিজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্থির করে নিতে হবে।
- নিজের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা ও মনোভাব – নিজের বয়স, আয় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী কতখানি ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত সেটা নির্ধারণ করতে হবে।
- ইউলিপের বৈশিষ্ট্য – কোন ধরনের প্ল্যানের কী কী বৈশিষ্ট্য সেগুলো জেনে নিতে হবে।
- চার্জ – কত হারে কী কী চার্জ প্রযোজ্য জানতে হবে।
- বিগত বছরে ফান্ডের পারফরম্যান্স – বিগত বছরে ফান্ডের পারফরম্যান্স বা রিটার্নের হার কেমন সেটাও দেখে নিতে হবে। মানিকন্ট্রোল ওয়েবসাইটের এই লিংক থেকে সব থেকে ভালো পারফর্ম করা ইউলিপগুলোর ব্যাপারে জানতে পারবেন।
কিভাবে ইউলিপ কেনা যায়?
একটা সাধারণ ইন্সুরেন্স প্ল্যানের মতোই অফলাইনে ইন্সুরেন্স কোম্পানির অফিস থেকে বা এজেন্টের মাধ্যমে কিংবা অনলাইনে তাদের নিজস্ব বা পলিসিবাজারের মত ইন্সুরেন্স এগ্রিগেটারের ওয়েবসাইট বা অ্যাপের মাধ্যমে এধরণের প্ল্যান কেনা যেতে পারে।
শেষ কথা
এই দুনিয়ায় কোনোকিছুই পুরোপুরি নিখুঁত নয়। ইউলিপ অনেক দিক থেকে ভালো মনে হলেও ৫ বছরের লক-ইন ও অন্যান্য নিয়মের বাঁধন, বিবিধ চার্জ, মিউচুয়াল ফান্ডের তুলনায় কম রিটার্ন ইত্যাদি কারণে অনেকের ভালো নাও লাগতে পারে। বীমা ও বিনিয়োগ একসাথে করে এটা পুরো ব্যাপারটাকে সহজতর করে। কিন্তু দুই ক্ষেত্রে আলাদা করে বিনিয়োগ করতে পারলে ঝঞ্ঝাট হয়তো বাড়ে তবে স্বাধীনতা বেশি পাওয়া যায় ও কিছু বেশি রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়। শেষপর্যন্ত কোন পথে আপনি যাবেন বা কোন পথটা আপনার জন্য সঠিক হবে সেটা আপনার জীবনের পরিস্থিতি ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করে।
আজ এখানেই ইতি টানছি। ভালো থাকবেন। 🙂
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
ইউলিপ ও মিউচুয়াল ফান্ডের তফাৎ কী?
ইউলিপে বিনিয়োগের পাশাপাশি জীবনবীমার সুবিধা পাওয়া যায় কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ডে কেবলমাত্র বিনিয়োগের সুবিধাই পাওয়া যায়।
ইউলিপে কি ঝুঁকি নেই?
ঝুঁকি ছাড়া বিনিয়োগের অস্তিত্ব নেই। এর ইউনিট শেয়ার বাজারের সাথে লিঙ্কড। তাই বাজারগত ঝুঁকি তো থাকেই।