এইযে পাঠকবন্ধু, কেমন আছেন? ইদানিংকালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যের যুবসমাজের জন্য কত কী ক্রেডিট কার্ড চালু করছে জানেন? বছর দুই আগেই ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার খরচ জোগাতে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড দেওয়া শুরু হয়েছিল। আর হালফিলে ব্যবসার পুঁজি জোগানোর জন্য নিয়ে আসা হয়েছে ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড।
দুই কার্ডের কথা শুনে যদি ভাবেন, একজন ছাত্রাবস্থায় স্টুডেন্ট ক্রেডিট ক্রেডিট কার্ড নিয়ে পড়াশোনা চালাতে পারবে, আর তারপর যদি কোনো চাকরি বাকরি না জোটে তখন ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের সাহায্যে ব্যবসা শুরু করে ভবিষ্যৎ সেট করতে পারবে! — তাহলে ভুল ভাববেন!
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড আসলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাজারো জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের মধ্যে আরও একটা প্রকল্পের নাম। এর মাধ্যমে এই রাজ্যের কোনো স্থায়ী বাসিন্দা যদি নিজের ব্যবসা শুরু করতে চায় তাহলে সরকারের সাবসিডি সহ ব্যাংক থেকে জমানতবিহীন লোন নিতে পারবে।
সারসংক্ষেপ এটাই। এবার চলুন এব্যাপারে বিষদে জেনে নিই…
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড প্রকল্পের লক্ষ্য কী?
রাজ্যে যত বেশি শিল্প বা ব্যবসা তৈরি হয়, বেকারত্ব যত কমে, মানুষের আয় যত বাড়ে, আর টাকা যত হাতবদল হয়, রাজ্যের ইকোনমি তত প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে আর সরকারের ট্যাক্স কালেকশনও বাড়ে। বর্ধিত ট্যাক্সের টাকায় সরকার রাজ্য এবং রাজ্যবাসীর উন্নতিসাধনে আরও কাজ করতে পারে ফলে রাজ্যের সামগ্রিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়।
এই প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে ব্যবসা করতে ইচ্ছুক এই রাজ্যের বেকার যুবক যুবতীদের হাতে ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি যোগানের ব্যবস্থা করে তাদের নিজেদের এবং সঙ্গে আরও কিছু বেকারের আয় তথা সম্পদ তৈরির রাস্তা প্রশস্ত করা। এবং সেটার মাধ্যমে রাজ্যের ইকোনমিকে আরও শক্তিশালী করা।
মানে এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য‘সবকা মঙ্গল সবকা ভালা…’। অন্ততপক্ষে সোজাসাপটা হিসেব তো তাই বলে। কিন্তু বাস্তবে এটা কতখানি ফলপ্রসু হবে সেটা তো ভবিষ্যৎ-ই বলবে…
কর্মসাথী প্রকল্প ভার্সন ২.০
২০২০ তে একই ধরণের অন্য একটা প্রকল্পের শুরু হয়েছিল, যেটার নাম ছিল কর্মসাথী প্রকল্প। এই প্রকল্পটা সেটারই আরও ভালো ভার্সন হিসেবে চালু হয় ২০২৩-এর এপ্রিল মাস থেকে। কর্মসাথী প্রকল্পের যে সমস্ত আবেদন এই নতুন প্রকল্প চালু হওয়া পর্যন্ত অমীমাংসিত ছিল সেগুলো এই নতুন প্রকল্পে মাইগ্রেট করে দেওয়া হয়।
কারা এই ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারবে?
এই কার্ডের জন্য তারাই আবেদন করতে পারবে যারা,
- পশ্চিমবঙ্গবাসী এবং এখানে কমপক্ষে ১০ বছর বসবাস করছেন।
- ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী।
কারা আবেদন করতে পারবে না?
- রাজ্য সরকারি এবং কেন্দ্র সরকারি কর্মচারী বা তাদের পরিবারের কেউ।
- অন্য কোনো লোন নিয়ে ব্যাংকে ডিফল্ট করেছে এরকম কেউ।
- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজন ইতিমধ্যেই আবেদন করে থাকলে অন্যজন।
কী কী ক্ষেত্রে এই ক্রেডিট কার্ড প্রকল্প প্রযোজ্য?
- ম্যানুফ্যাকচারিং, সার্ভিস, ট্রেডিং বা বিজনেস, ফার্ম (যেমনঃ ডেয়ারি, ফিশারি, পোল্ট্রি) ইত্যাদি সেক্টরে টাকা পয়সা আসে এমন ধরণের যেকোনো প্রোজেক্টে ফান্ডিং-এর ক্ষেত্রে।
- নতুন এবং পুরানো, দুই ধরনের প্রোজেক্টেই টার্ম লোন, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন বা কমপোজিট লোনের ক্ষেত্রে।
কী কী ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়?
যেকোনো নেশাদ্রব্য সংক্রান্ত সামগ্রী যেমন গুটখা, পান, বিড়ি, সিগারেট ইত্যাদি উৎপাদন বা বিক্রি সক্রান্ত ব্যবসার ক্ষেত্রে এই কার্ড পাওয়া যাবেনা।
সর্বাধিক কত টাকা পাওয়া যেতে পারে?
৫ লাখ পর্যন্ত ক্যাপিটাল লাগে এমন প্রোজেক্টে এই প্রকল্পে সর্বাধিক ওই ৫ লাখ পর্যন্তই লোন পাওয়া যেতে পারে।
কতটা সাবসিডি পাওয়া যাবে?
প্রোজেক্টের খরচ যত হবে তার ১০% মার্জিন মানি হিসাবে সরকারের থেকে সাবসিডি পাওয়া যাবে। তবে সাবসিডির সর্বাধিক পরিমাণ হতে পারে ২৫০০০ টাকা। প্রোজেক্টের খরচ অনুযায়ী কত সাবসিডি পাওয়া যাবে এবং ব্যাংক লোন হিসাবে কত শোধ করতে হবে তার উদাহরণ হিসাবে নীচের তালিকাটা দেখে নিন।
প্রোজেক্টের খরচ | সাবসিডি | ব্যাংক লোন |
---|---|---|
১০০০০০ | ১০০০০ | ৯০০০০ |
১৫০০০০ | ১৫০০০ | ১৩৫০০০ |
২০০০০০ | ২০০০০ | ১৮০০০০ |
২৫০০০০ | ২৫০০০ | ২২৫০০০ |
৩০০০০০ | ২৫০০০ | ২৭৫০০০ |
৪০০০০০ | ২৫০০০ | ৩৭৫০০০ |
৫০০০০০ | ২৫০০০ | ৪৭৫০০০ |
এই সাবসিডির বিশেষ বৈশিষ্ট্য
- এই লোনে যে সাবসিডি পাওয়া যাবে সেটা কেবলমাত্র একবারের জন্যই পাওয়া যাবে। ধরুন আপনি ব্যবসা শুরু করার জন্য ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে একটা ৩ লাখ টাকার প্রাথমিক লোনের জন্য আবেদন করলেন। লোন মঞ্জুর হলে আপনি এক্ষেত্রে ২৫০০০ টাকার সাবসিডিও পাবেন। অতঃপর ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে সেটা আরও বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বা অন্য কোনো কারণে পরে আবার যদি টপ-আপ লোনের আবেদন করেন সেক্ষেত্রে কিন্তু লোন পেলেও সাবসিডি টা আর পাবেন না।
- সাবসিডি পাওয়ার ছ’মাসের মধ্যে পাওয়া টাকা ব্যবহার না করে ফেললে সেটা কিন্তু ফিরিয়ে দিতে হবে।
ক্রেডিট গ্যারান্টি এবং বাৎসরিক গ্যারান্টি ফি
এই লোনের ৮৫%-এর গ্যারান্টি কভারেজ দেবে ক্রেডিট গ্যারান্টি ট্রাস্ট ফান্ড ফর এমএসইস (CGTMSE) এবং বাকি ১৫%-এর কভারেজ দেবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
সিজিটিএমএসই-র ৮৫% কভারেজের জন্য ০.৩৭% বাৎসরিক গ্যারান্টি ফি দিতে হবে, তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অংশটুকুর জন্য কোনো ফি লাগবে না।
লোনটা কোন ব্যাংক থেকে পাওয়া যাবে?
পাবলিক সেক্টর, প্রাইভেট সেক্টর, রুরাল, কো অপারেটিভ, স্মল ফাইন্যান্স ইত্যাদি বেশীরভাগ ব্যাংকই এই লোন অনুমোদন করবে।
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের জন্য কিভাবে আবেদন করতে হবে?
- অনলাইনেঃ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অফিসিয়াল WBBCCS পোর্টালে এই → আবেদনের লিংক থেকে আবেদন করা যাবে।
- অফলাইনেঃ এক্ষেত্রে দুয়ারে সরকার ক্যাম্পে কিংবা বিডিও / এসডিও / ডিাইসি অফিস থেকে ফর্ম তুলে ফিলাপ করে সমস্ত ডকুমেন্ট সহ সাবমিট করতে হবে। চাইলে এই লিংক থেকে ফর্ম ডাউনলোড করে প্রিন্ট-ও করে নিতে পারেন।
আবেদন করার ক্ষেত্রে কী কী ডকুমেন্ট লাগবে?
- যেকোনো স্বীকৃত সচিত্র পরিচয় পত্র।
- ঠিকানার প্রমাণপত্র।
- বয়সের প্রমাণপত্র।
- প্যান কার্ড।
- বিস্তারিত প্রোজেক্ট রিপোর্ট (ডিপিআর) – এটা কেমন হবে তার বিবিধ উদাহরণ পাবেন এই লিংকে, আর ফাঁকা ডিপিআর-এর এক্সেল ফরম্যাট চাইলে এই লিংক থেকে ডাউনলোড করতে পারবেন।
খুব সহজেই অনুমোদন পাওয়ার জন্য যে বিষয়গুলোর উপর লক্ষ্য রাখা জরুরী
- এলিজিবিলিটি ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী ডকুমেন্ট যেন ঠিকঠাক থাকে।
- প্রোজেক্টের জন্য জায়গা বা শেড যেন দেখা / রেডি থাকে।
- যে প্রোজেক্ট সাবমিট করা হবে সে সম্পর্কে যেন যথেষ্ট জ্ঞান থাকে।
- প্রোজেক্ট সংক্রান্ত ট্রেনিং নেওয়া থাকলে অনুমোদন পেতে সুবিধা হবে।
এই প্রকল্পে লোন-যোগ্য এবং ৫ লাখ পর্যন্ত খরচ এমন কিছু প্রোজেক্টের উদাহরণঃ
ক্ষেত্র | প্রোজেক্টের উদাহরণ |
---|---|
কৃষিভিত্তিক শিল্প | ধান ভাঙা, ধান স্টোর করা, সাল পাতার প্লেট তৈরি, শীতল পাটি তৈরি ইত্যাদি |
পশু উৎপাদন | পোলট্রি ফার্ম, ডেয়ারি ফার্ম ইত্যাদি |
রাসায়নিক শিল্প | সিমেন্টের পণ্য, চপ্পল তৈরি, ধুপ তৈরি, লিকুইড সাবান তৈরি ইত্যাদি |
বৈদ্যুতিন শিল্প | পাখা তৈরি, এলইডি বাল্ব তৈরি ইত্যাদি |
খাদ্য পণ্য | বেকারি, ফাস্ট ফুড, আটা, চিপস ও চানাচুর, তেল, মশলা, চাউমিন, পাঁপড়, মিষ্টি তৈরি ইত্যাদি |
হস্তশিল্প | মাটির পুতুল তৈরি, টেরাকোটা, এমব্রয়ডারি করা ইত্যাদি |
চর্মশিল্প | চামড়ার জুতো, ব্যাগ ইত্যাদি তৈরি |
যান্ত্রিক শিল্প | আলমারি, শোকেস, অ্যালুমিনিয়াম ফার্নিচার, স্টিল ফার্নিচার, রট আয়রন ফার্নিচার ইত্যাদি তৈরি |
পরিষেবা | এসি, ফ্রিজ সারাই, বাইক ও গাড়ি সার্ভিসিং, সেলুন, বিউটি পার্লার, কম্পিউটার সার্ভিস, সাইবার ক্যাফে, ডেকোরেশন সার্ভিস, টোটো রিপেয়ার, হোম ডেলিভারি, প্রিন্টিং, মোবাইল রিপেয়ার, রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকান, জেরক্স ও ল্যামিনেশন ইত্যাদি |
টেক্সটাইল ও সহযোগী শিল্প | রেডিমেড পোশাক, মেয়েদের অন্তর্বাস তৈরি, জরির কাজ, ব্যাগ তৈরি, লেপ বালাপোষ তৈরি ইত্যাদি |
ব্যবসা ও দোকান | বই, কসমেটিকস, ইলেকট্রিক্যাল, মুদিখানা, হার্ডওয়ার, মোবাইল, ঘড়ি ইত্যাদির দোকান, বিস্কুট ডিস্ট্রিবিউটার, চালের ব্যবসা ইত্যাদি |
কাঠের পণ্য | কাঠের আসবাবপত্র তৈরি |
এক নজরে ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড প্রকল্প
প্রকল্পের নাম | ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড |
স্থান | পশ্চিমবঙ্গ |
শুরু | ১লা এপ্রিল, ২০২৩ |
সুবিধাভোগী | পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা (কমপক্ষে ১০ বছর বসবাসকারী) |
বয়সের সীমা | ১৮-৪৫ বছর |
সুবিধা | ব্যবসার জন্য সর্বাধিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লোন |
লোন অনুমোদনকারী | ব্যাংক |
সাবসিডি | ১০%, সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা |
অফিসিয়াল ওয়েবসাইট | https://bccs.wb.gov.in/ |
অনলাইনে আবেদনের লিংক | এখানে ক্লিক করুন |
অফলাইনের ফর্ম ডাউনলোড | এখানে ক্লিক করুন |
হেল্পলাইন | (০৩৩)২২৬২-২০০৪ |
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
পরিবারের আয় কত হলে তবে এই কার্ড পাওয়া যাবে?
পরিবারের আয় যাই হোক না কেন, এই কার্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে এব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
কোনো জমানত বা আলাদা কোনো গ্যারান্টি লাগবে কি?
না। গ্যারান্টির দায়িত্ব সরকার এবং সিজিটিএমএসই-র।
আবেদন করার সময় কোনো ফি লাগবে কি?
না। আবেদনের ক্ষেত্রে কোনো চার্জ লাগেনা।
একজন আবেদনকারী একসাথে ২ বার আবেদন করতে পারবে?
না।