শেয়ার বাজারে ধস নামলে কী করা উচিৎ?

5/5 - (5 জন রেটিং করেছেন)

শেয়ার বাজার কখনও যেমন ষাঁড়ের মতো উঠবে ফুঁসবে ছুটবে তেমনই কখনও আবার ভোল পাল্টে ভালুকের মতো নামবে পড়বে ধসবে… এই বাজারের একমাত্র সত্যি এটাই। আপনি যতই ভালো করে শিখুন, অ্যানালিসিস করুন বা ভালো ভালো শেয়ার বাছুন, এখানে মন্দা বা ধস কখনও না কখনও আসবেই। আর যখন তা আসবে তখন তার প্রভাব আপনার পোর্টফোলিওতেও পড়বে। ধসের আঁচ থেকে কেউ বাঁচতে পারে না। যখন ধস নামে তখন তার প্রভাব ভালো মন্দ সব শেয়ারের দামেই পড়ে।

কিন্তু সেসময়ে আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষের কি করা উচিৎ?

ধস নামার সময় শেয়ার বাজারে অংশগ্রহণের বিচারে 4 ধরণের মানুষ…

ধস নামার সময় শেয়ার বাজারের সাথে সেসময়ের সম্পর্কের উপর বিচার করে এখানে অংশগ্রহণকারীদের চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে…

  • এক, যারা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছেন কিন্তু এখনও পর্যন্ত বিনিয়োগ করেননি।
  • দুই, যারা কেবলমাত্র কোনও মিউচুয়াল ফান্ডে এসআইপি করে রেখেছেন।
  • তিন, যারা শর্ট টার্ম ট্রেডার।
  • চার, যারা লং টার্ম ইনভেস্টর।

চলুন এবার ধসের সময় এই চার দলের কার্যকলাপ কেমন হওয়া উচিৎ সেবিষয়ে কাটাছেঁড়া করা যাক… 

যারা এখনও বিনিয়োগ শুরু করেন নি…

এই দলে যারা পড়েন তাদের জন্য ধস নামার সময়টাই সবথেকে উত্তম সময় শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ শুরু করার। কারণ ধস নামার সময় ভালো ভালো শেয়ার অনেক কম দামে পাওয়া যায়। ভালো ভালো কোম্পানি যেকোনো ধরণের প্রতিকুল পরিস্থিতির সামাল দেয় খুব সহজেই। তাছাড়া পুরো শেয়ার বাজারে যখন ধস নামে তখন শেয়ারের দামের পতনের কারণটা কোম্পানির আভ্যন্তরীণ হয় না। তাই ভালো কোম্পানির ক্ষেত্রে সাধারণত শেয়ারের দামের এই পতন বেশিদিন স্থায়ী হয় না। আর এ সময় বিনিয়োগ শুরু করলে অনেক কম সময়ে অনেক বেশি রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি হয়।

আরও পড়ুনঃ  শেয়ার বাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকি কমানোর 10 উপায়। #3 সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ

যাদের এসআইপির মাধ্যমে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা আছে…

শেয়ারবাজারে বড় কোনো ধস নামলে যাদের কোনো মিউচুয়াল ফান্ডে আগে থেকেই এসআইপি করা আছে তাদের মনে হতেই পারে এসআইপি বন্ধ করে দেবেন নাকি চালু রাখবেন।

এসআইপি করা মানে কিন্তু এধরনের পড়া বা বাজার যখন ওঠে সেসময়ের ওঠা বা মাঝামাঝি সময়ের বিভিন্ন দামের মধ্যে একটা গড় অনুসরণ করে চলা। বাজার যেমনই চলুক, এসআইপি চলে তার নিজের ছন্দে। তাই ধসের সময়ের যে ইন্সটলমেন্ট গুলো কাটে সেগুলোয় আসলে বেশি লাভ হয় কারণ সেসময়ে ফান্ডের নেট অ্যাসেট ভ্যালু কম থাকে এবং অন্য সময়ের মতো একই দামে বেশি ইউনিট পাওয়া যায়।

কিন্তু বাজারে ধসের সময় যদি এসআইপি বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে এই লাভটা পাওয়া যায় না। এবং কেউ জানেনা বাজার আবার কোন মুহূর্তে ঘুরতে আরম্ভ করবে। তাই এসআইপি যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ করে দেওয়াটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

যারা শর্ট টার্ম ট্রেডার…

শর্ট টার্ম ট্রেডাররা শেয়ার বাজারের ছোটো-বড়, উপর-নিচ সব রকম মুভমেন্ট থেকে লাভ করার চেষ্টা করেন। মার্কেট যত উপর নিচে মুভ করে ট্রেডাররা তত পজিশন নেওয়ার সুযোগ বেশি পান এবং লাভ করার সম্ভাবনা ততই বাড়ে। আর মার্কেট যখন তাদের এক্সপেকটেশনের উল্টো দিকে যায় তার সাথে ডিল করার জন্য তারা স্টপ লস ব্যবহার করেন।

তাই কোনো ট্রেডার যদি লং পজিশন নেওয়ার পরে বাজারে বড় কোনও ফল হয় তখন সেই ফল বড় হওয়ার আগেই সেই ট্রেডার তার নির্ধারিত স্টপ লসে সামান্য ক্ষতি হজম করে বেরিয়ে যান। এছাড়া ট্রেডাররা সাধারণত বড় বড় ফলগুলোকে শর্ট পজিশন নিয়ে নিজেদের মুনাফার কাজে ব্যবহার করেন।

সুতরাং বাজারে বড় ধস নামলে শর্ট টার্ম ট্রেডাররা তাদের ব্যবহৃত স্ট্রাটেজি অনুযায়ী লং পজিশন হলে স্টপলস ব্যবহার করে পজিশন ক্লোজ করে এবং শর্ট পজিশন নিয়ে লাভ করার চেষ্টা করতে পারেন।

এ ব্যাপারে আরও বিশদে জানতে শেয়ার বাজার পড়লে বা শেয়ারের দাম কমলে যারা খুশি হন তাদের সম্পর্কে এবং ট্রেডিং শুরু করার প্রথম ধাপগুলোর ব্যাপারে জেনে নিতে পারেন।

যারা লং টার্ম ইনভেস্টর

কিংবদন্তি ইনভেস্টর ওয়ারেন বাফেটের মত ইনভেস্টর হতে চাইলে বাজারের উত্থান পতনে বিচলিত হলে চলবে না। ভালো ইনভেস্টারের কাজ হচ্ছে ভালো কোম্পানি খুঁজে বের করা তারপরে সেখানে ইনভেস্ট করে বছরের পর বছর কিংবা দশকের পর দশক হোল্ড করে থাকা। তাই লক্ষ্য যেখানে এত লম্বা সময়ের সেখানে সাময়িকভাবে বাজারে কোনো ধস নামলেও চিন্তা করার কিছুই নেই। কারণ কোন ধসই অসীম সময়ের জন্য স্থায়ী হয় না।

আরও পড়ুনঃ  সবথেকে সেরা 10+ চার্ট প্যাটার্ন। এগুলো না জেনে শেয়ার ট্রেডিং সম্ভব নয়।

তবুও ধস চলাকালীন সময়ে কিংবা ধসের সাথে ডিল করার জন্য ইনভেস্টর রাও কিছু কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন যেমন —

প্রফিট বুকিং বা সেল নয়

লং টার্ম ইনভেস্টর হলে এক্সিস্টিং পোর্টফোলিওতে প্রথম যা করা উচিত সেটা হচ্ছে কিছু না করা বা সেল করার কথা না ভাবা। বাজারে বড় ফল হলে মনে হতেই পারে যে আপাতত সেল করে দিয়ে আরো কম দামে পরে কেনা যাবে। কিন্তু কখন সেই মুহূর্ত আসবে, মানে কখন আরো কম দামে কেনা যাবে বা কখন বাজার নিম্নতম পজিশনে নামবে বা সেল করার পরে আদৌ আর নামবে কিনা সেটা কিন্তু কেউ জানে না। এবং এমনও তো হতে পারে, সেল করে দেওয়ার পরেই হয়তো বা বাজার আবার উঠতে আরম্ভ করল।

তাই যদি ইনভেস্ট করা কোম্পানির উপর বিশ্বাস থাকে তাহলে এ কাজটা করতে না যাওয়াই ভালো। তাছাড়া বারবার কেনাবেচা করলে কিন্তু আবার ব্রোকারেজ ফী তেও অনেকটা লাভ খেয়ে ফেলে।

তাই এক্ষেত্রে বাফেট বাবু এবং অন্যান্য বড় বড় কিংবদন্তি ইনভেস্টারদের মতে যখন বাজারে বড় কোন ধস নামে তখন বাজার বা শেয়ারের মুভমেন্টের দিকে খুব খুঁটিয়ে নজর না রাখাই ভালো তাতে ইমোশনাল হয়ে ভুল করে সেল করার সম্ভাবনাটা কমে।

পারলে আরো শেয়ার কেনা যেতে পারে

বাফেট বাবুর ইনভেস্টিং-এর নীতি গুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে সব সময় কিছু ক্যাশ রিজার্ভ রাখা। যাতে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তার ব্যবহার করা যায়।

একটু আগেই যা বলেছি, শেয়ার মার্কেটে ধস মানে পছন্দের শেয়ারগুলো বা নিজের পোর্টফোলিওর শেয়ার গুলো অনেক কম দামে পাওয়া যায় তাই ওই সময়ে রিজার্ভ করা ক্যাশের সদ্ব্যবহার করে আরো আরো শেয়ার কেনা যেতে পারে।

পোর্টফোলিও রিব্যালেন্সিং

শেয়ারবাজারে ধসের সময় বেশীরভাগ শেয়ার তাদের আসল রূপ প্রকাশ করে। খুব ভালো কোম্পানির ও মাঝামাঝি প্রাইস টু আর্নিং রেশিও ওয়ালা শেয়ারের দাম সাধারণত ধসের সময় তুলনামূলক কম পড়ে এবং গন্ডগোলের কোম্পানি ও অস্বাভাবিক হাই প্রাইস টু আর্নিং রেশিও ওয়ালা শেয়ারের দাম অনেক বেশি পড়ে। তাই ধসের পর পোর্টফলিওর কোন শেয়ারের দামের কত ফল হয়েছে সেটা অনুযায়ী পোর্টফোলিও কিছুটা রি-ব্যালেন্সিং করে নেওয়া যেতে পারে এবং পোর্টফোলিওর বাইরে কোনো ভালো কোম্পানির শেয়ার মনের মত দামে পাওয়া গেলে অ্যাড করে নেওয়া যেতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  10 বছরে কিভাবে কোটিপতি হওয়া যায়? এটা কি আদৌ সম্ভব...?

ডাইভারসিফিকেশন

শেয়ারবাজারে আনএক্সপেকটেড ধস থেকে নিজের পোর্টফোলিওকে বাঁচানোর একটা উপায় হল ডাইভারসিফিকেশন। ডাইভারসিফিকেশন মানে শেয়ার বাজারের ভেতরে বিভিন্ন সেক্টরের বিভিন্ন রকমের শেয়ার কেনা ছাড়াও বিনিয়োগের অন্যান্য বিকল্প উপায় অনুসরণ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা। কারণ সাধারণত শেয়ার বাজারে যখন ধস নামে তখন দেখা যায় অন্য কোন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে (যেমন সোনা) লাভ বেড়ে যায়।

তাই, যদি আগে থেকেই ডাইভারসিফাই করা থাকে তাহলে তো খুবই ভালো। তবে না করা থাকলে ডাইভারসিফাই করার কথা ভাবা যেতে পারে।

সম্পর্কিতঃ বিনিয়োগে ডাইভারসিফিকেশন কী? কেন? কিভাবে?

ডেরিভেটিভ দিয়ে হেজিং

হেজিং হচ্ছে পোর্টফোলিও রিস্ক ম্যানেজমেন্টের একটা স্ট্রাটেজি। এটা খানিকটা পোর্টফোলিওর ইন্সুরেন্সের মতো ভাবা যেতে পারে।

বাজার পড়তে পারে আন্দাজ করতে পারলে বা বাজার আরো পড়বে এ ধরনের কিছু সিগন্যাল পেলে যথাযথ ফিউচার ডেরিভেটিভ শর্ট করে বা পুট অপশন কিনে বাজারে ধসের সময় পোর্টফোলিওর ভ্যালু কমে যাওয়া থেকে বাঁচানো যেতে পারে।

তবে এটা করলে ইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম এর মতোই এক্সট্রা কিছু খরচ হয় যেটা লাভের অংকে ভাগ বসায়।

শেষ কথা

শেষকালে একটাই কথা বলতে চাইবো নিজের পোর্টফোলিওকে বাঁচানোর এবং বাড়ানোর দায়িত্ব সম্পূর্ণ নিজের। আর লাভ হোক বা লস হোক সেটাও হবে নিজেরই। তাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আরও পড়াশোনা করতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে। তবেই একজন ভালো ট্রেডার বা ইনভেস্টার হয়ে ওঠা যাবে।

মন্তব্য করুন