পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডঃ সুবিধা নাকি ঝঞ্ঝাট?

5/5 - (3 জন রেটিং করেছেন)

শিক্ষা ছাত্র-ছাত্রীর মেরুদন্ড; শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। এই শিক্ষালাভ চাইলে একটা বয়স পর্যন্ত বিনা খরচেই করা যায়। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণত বিনামূল্যে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। এবং কোনো কোনো বিষয় বা কোর্সে বেশ মোটা খরচের বোঝা বহন করতে হয়। তাই ইচ্ছা থাকলেও পছন্দের বিষয়ে উচ্চশিক্ষার খরচ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য সকল ছাত্রছাত্রীর বা তাদের পরিবারের হয়না।

অর্থাভাবে যাতে রাজ্যের কোনো শিক্ষার্থীর পড়াশোনার স্বপ্ন পূর্ণতা প্রাপ্তির আগেই ভেঙে না যায় সেই উদ্দেশ্যে ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড প্রকল্প চালু করা হয়। কিন্তু এই মহৎ উদ্দেশ্য পূরণে এই প্রকল্প কতটা সফল? এই প্রকল্পের ভালো ও খারাপ দিকগুলো কী? সেসব নিয়েই আলোচনা করব এই নিবন্ধে…

স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড আসলে কী?

এটার নামে ‘ক্রেডিট কার্ড’ কথাটা থাকলেও এটা সাধারণ ক্রেডিট কার্ডের মতো যেখানে খুশি খরচ করার বা পেমেন্ট করার কোনো কার্ড নয়। এটা আসলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রণোদিত শিক্ষাঋণের একটা প্রকল্পের নাম। এই প্রকল্পের আওতায় ব্যাংক থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য কম সুদে ঋণ পাওয়া যায়। এবং ঋণের টাকা শোধ করার জন্য লম্বা সময়ও মেলে।

তবে এই প্রকল্পের আওতায় পাওয়া ঋণের টাকা আসলে সরকার দেয়না, দেয় যে ব্যাংকে আবেদন করা হচ্ছে সেই ব্যাংক। আর ব্যাংক এমনিতে এই ঋণের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব সুদের হারই চার্জ করে। তবে সরকারের তরফে অতিরিক্ত সুদের টাকা সাবসিডি হিসাবে ব্যাংক-কে প্রদান করা হয় যাতে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দেয় সুদের হার এই স্কিমের সুদের হারের সমান হয় (সরল ৪%)।

আরও পড়ুনঃ  ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ২০+ সুবিধা। #৫ আমার সবথেকে প্রিয়...!
স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড প্রকল্পের ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির টুইট

এই প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধাঃ

  • স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড প্রকল্পের আওতায় বার্ষিক ৪% সরল সুদের হারে সর্বাধিক ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত শিক্ষাঋণ পাওয়া যেতে পারে।
  • পশ্চিমবঙ্গের দশম শ্রেণী বা তার উপরে পাঠরত যেকোনো শিক্ষার্থী দেশে ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার যেকোনো কোর্সের জন্য এই ঋণ পাওয়ার যোগ্য।
  • এমনকি বিবিধ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশিক্ষণের কোর্সের ক্ষেত্রেও এই প্রকল্প প্রযোজ্য।
  • কোর্স ফি বাদে হোস্টেল ফি ও কোর্সের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য খরচও এই ঋণের টাকায় শোধ করা যায়।
  • কোর্স চলাকালীন যেকোনো সময়ে এই ঋণের জন্য আবেদন করা যায়।
  • সমস্ত সরকারি, বেসরকারি, কো-অপারেটিভ বা রিজিওনাল রুরাল ব্যাংক এই আবেদন গ্রহন করে।
  • ঋণ শোধ করার জন্য পনেরো বছরের লম্বা সময় পাওয়া যায়।
  • পড়াশোনা চলাকালীন সম্পূর্ণ সুদ শোধ করলে সুদের হারে অতিরিক্ত ১% ছাড় পাওয়া যায়।
  • ঋণ শোধ করার ক্ষেত্রে চাইলে কোর্স শেষ করার ১ বছর পর্যন্ত দেনা স্থগিত রাখা যায় (মোরাটরিয়াম)।
  • কোনো প্রসেসিং ফি বা প্রি ক্লোজার ফি লাগে না।

প্রকল্পের সীমাবদ্ধতাঃ

  • বয়স ৪০ বছরের বেশী হলে আবেদন করা যায় না।
  • পশ্চিমবঙ্গের কমপক্ষে ১০ বছরের স্থায়ী বাসিন্দা না হলে এই ঋণ পাওয়া যায়না।
  • কেবলমাত্র বর্তমানে পাঠরত কোর্সের ক্ষেত্রেই আবেদন করা যায়। এবং কোর্স শুরু করার আগে টাকা পাওয়া যায়না।
  • একসাথে একাধিক কোর্সের জন্য আবেদন করা যায়না।
  • কোর্স ফি-এর যে অংশটা ইতিমধ্যে দেওয়া হয়ে গেছে সেই টাকা ঋণ হিসাবে পাওয়া যায়না। কেবলমাত্র আবেদনের পরবর্তীকালে দেয় টাকাটাই ঋণ হিসাবে পাওয়া যায়।
  • ৪ লাখের উপরে ঋণের জন্য ৫% মার্জিন মানি দিতে হয়।
  • থাকা খাওয়ার জন্য ঋণের ২০%-এর বেশী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কারণে ৩০%-এর বেশী ব্যয় করা যায়না।
  • ঋণের গ্যারেন্টার সরকার হলেও ঋণ নেওয়ার পর ঋণ শোধ করার সম্পূর্ণ দায় পড়ে ঋণগ্রহীতা ও সহ-ঋণগ্রহীতা মানে তার অভিভাবকের উপর।
  • লাইফ কভারের প্রিমিয়ামের জন্য অতিরিক্ত খরচ হয়।
  • কার্ড থেকে সরাসরি লেনদেন করা যায়না।
আরও পড়ুনঃ  ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি কিভাবে হয়? এর থেকে বাঁচবেন কিভাবে...?

স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদনের নিয়মঃ

আবেদনের জন্য অফিসিয়াল ওয়েবসাইট wbscc.wb.gov.in -এ গিয়ে স্টুডেন্ট রেজিস্ট্রেশন সেকশন থেকে সেখানে দেওয়া ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী আবেদন করতে হয়।

আবেদনের পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশের ব্যাপারে জানতে চাইলে ম্যানুয়াল হিসাবে অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া এই পিডিএফ ফাইল টা দেখে নিতে পারেন। এছাড়া এব্যাপারে আপনার বিবিধ প্রশ্নের উত্তর পাবেন এই প্রশ্ন-উত্তরের পিডিএফ ফাইলটায়। অন্যান্য যেকোনো সাহায্যের জন্য অফিসিয়াল হেল্পলাইন নম্বর 1800-102-8014 -তে কল করা যেতে পারে।

এই প্রকল্পের আওতায় ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে যেসমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছেঃ

প্রকল্পটা এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু করা হলেও বাস্তবে ছাত্রছাত্রীদের এই প্রকল্পের আওতায় ঋণ পেতে বা ঋণ পাওয়ার পরও অনেক ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যেমন,

  • ঋণ অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ যেহেতু ব্যাংক তাই আবেদন করার পর ব্যাংকই ঠিক করে কাকে তারা লোন দেবে আর কাকে দেবে না। ফলে ব্যাংক যেসমস্ত ছাত্রছাত্রীকে ঋণ দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে তাদের ঋণ পেতে সমস্যা হচ্ছে। এবং একটা ব্যাংক ফিরিয়ে দিলে আবার অন্য ব্যাংকে আবেদন করতে হচ্ছে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের হয়রানির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
  • সব সমস্যা পেরিয়ে ঋণ পেলেও পেতে অনেক সময় অনেকটা দেরি হয়ে যাচ্ছে, ফলে ঋণ পাওয়া পর্যন্ত ফি ও অন্যান্য খরচ চালাতে শিক্ষার্থীদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
  • অনেক সময় ব্যাংক শিক্ষার্থী বা তার বাবার ক্রেডিট স্কোরে কোনো গলদ খুঁজে পেলে ঋণ অনুমোদন করছে না।
  • আবার কখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কোর্স বা শিক্ষার্থীর মেধার মান সন্তোষজনক না হলে অনুমোদন পাওয়া যাচ্ছে না।
  • কখনো আবার নির্ধারিত সুদের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
  • এমনকি এমন অভিযোগও শোনা যাচ্ছে যে কিছু কিছু ব্যাংক বাবার আয় ও সম্পদ যাচাই করে, এমনকি কিছু বন্ধক রাখলে তবে ঋণ দিতে রাজি হচ্ছে।

সুত্রঃ জি নিউজ, এ বি পি আনন্দ, দি ওয়াল, এসিয়ানেট নিউজ এবং এক ঋণগ্রহীতার স্বীকারোক্তিঃ

আরও পড়ুনঃ  ক্রেডিট কার্ড কত ধরণের হয়? বেশি লাভ পেতে আবেদনের আগেই জানুন!

শেষ কথা

আমার মতে প্রকল্পটা খারাপ নয়, কিন্তু এটা দারুণ হতে পারত যদি এটার এক্সিকিউশনটা আরো ভালো হতো…। তবে আশার কথা হচ্ছে এই প্রকল্পের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে সরকারের তরফে টাস্ক ফোর্স তৈরি করা হয়েছে। বাকিটা ভবিষ্যৎ বলবে…

এই প্রকল্পের ব্যাপারে আপনার মতামত কী? কমেন্টে জানানোর অনুরোধ রইল।

আজ তাহলে এখানেই শেষ করি। ভালো থাকবেন।


প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)

সর্বোচ্চ কতবার স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করা যায়?

আবেদনের কোনো সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। তাই যতবার খুশি আবেদন করতে কোনো অসুবিধে নেই।

এই কার্ড পেতে ন্যূনতম কত আয়ের প্রয়োজন?

এটা ছাত্রদের জন্য ক্রেডিট প্রকল্প। তাই এই কার্ড পেতে কোনো আয়ের দরকার নেই।

একজন শিক্ষার্থী কি একাধিক কার্ড পেতে পারে?

না। প্রতি শিক্ষার্থী পিছু একটাই কার্ড দেওয়া হয়।

মন্তব্য করুন