ইউপিআই ভারতের এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন। পছন্দের পেমেন্ট অ্যাপ দিয়ে যেকোনো কিউআর (ইউপিআই) কোড স্ক্যান করে ইচ্ছেমত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে কত সহজে ও নিরাপদে ক্যাশলেস পেমেন্ট করা যেতে পারে সেটা ভারতই প্রথম করে দেখিয়েছে। পৃথিবীর সব থেকে উন্নত দেশ আমেরিকাও এখনো পর্যন্ত এর সমতুল্য কোনো প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারেনি। তাই একজন ভারতীয় নাগরিক হিসাবে এই ইউপিআই-এর জন্য আমি গর্বিত।
ইউপিআই লঞ্চ হয়েছিল ২০১৬ সালে। ওই বছরের জুলাই মাসে এই প্ল্যাটফর্মে মোট ট্রানজাকশনের সংখ্যা ছিল মাত্র ৯০ হাজার। আর এখন মানে এ বছরের জুন মাসে সেই ট্রানজাকশন সংখ্যা 9 কোটি পার করেছে। কি ধরণের ঝড়ের বেগে এর ব্যবহার বেড়েছে সেটা আশাকরি বুঝতেই পারছেন!
এই প্ল্যাটফর্মটা প্রথমদিকে শুধুমাত্র ব্যাংক অ্যাকাউন্টই সাপোর্ট করত। কিন্তু ইদানিংকালে সেটা বদলাতে শুরু করেছে। কী সেই বদল এবং এর ব্যবহারকারী হিসাবে আপনার আমার উপর তার প্রভাব কিভাবে পড়তে চলেছে সেটাই আলোচনা করব এই নিবন্ধে।
ইউপিআই কী?
প্রধান বিষয়ে যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন এই ইউপিআই আসলে কী। এর পুরো কথা ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস। এটা ন্যাশনাল পেমেন্ট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া বা এনপিসিআই প্রবর্তিত একটা তাৎক্ষণিক রিয়েল-টাইম ইন্টার-ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম। এর মাধ্যমে যেকোনো দুটো ব্যাংকের মধ্যে পিয়ার-টু-পিয়ার বা পিয়ার-টু-মার্চেন্ট লেনদেন করা যায়। অর্থাৎ প্রেরক এবং প্রাপকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যেখানেই থাকুক না কেন এর সাহায্যে এক ব্যক্তি আরেক ব্যক্তিকে কিংবা অনলাইন ও অফলাইনে কেনাকাটা ও বিল মেটানোর সময় মার্চেন্ট পেমেন্ট করতে পারে।
এই প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার করার জন্য স্মার্টফোনের দরকার পড়ে (তবে নতুন আপডেটের পর এখন ফিচার ফোনে এবং বিনা ইন্টারনেটেও এর ব্যবহার করা যায়)। স্মার্টফোনে ইউপিআই সাপোর্টেড যেকোনো পেমেন্ট অ্যাপ (যেমন ফোনপে, গুগলপে, পেটিএম, ভীম, যেকোনো ব্যাংকের অ্যাপ ইত্যাদি ) ইন্সটল করে প্রথমত একটা ফোন নম্বর দিয়ে রেজিস্টার করতে হয়। অতঃপর ঐ ফোন নম্বরের সাথে যুক্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট লিংক ও ইউপিআই পিন সেট করে নিলেই প্রস্তুতি পর্ব শেষ হয়। এরপর যেকোনো ইউপিআই কিউআর কোড স্ক্যান করে কিংবা ইউপিআই আইডি ব্যবহার করে এবং সেট করা পিন এন্টার করে খুব সহজেই পেমেন্ট করা যায়।
নতুন পরিবর্তন
ইউপিআই লঞ্চ হওয়ার সময় থেকে ২০২২ পর্যন্ত ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে এতে শুধুমাত্র ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই লিংক করা যেত। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতাটা ২০২২-এর নতুন এক আপডেটের পর থেকে আর নেই। ঐ বছরের জুন মাস থেকে এর সাথে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ড লিংক করার ব্যবস্থাপনাও চালু করা হয়েছে।
ক্রেডিট কার্ডে আলাদা কিছু সুযোগসুবিধা পাওয়া যায় যেগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে পেমেন্ট করলে পাওয়া যায় না। ইউপিআই তে এই কার্ড লিংক করা যাওয়ায় এই প্ল্যাটফর্মেও ঐ সমস্ত সুবিধাগুলো পাওয়ার রাস্তা তৈরি হয়েছে। এছাড়া যেখানে সাধারনভাবে এই কার্ডের সাহায্যে পেমেন্ট করতে হলে ফিজিক্যাল কার্ড সোয়াইপ করতে হয় বা কন্টাক্টলেস মোড ব্যবহার করতে হয় সেখানে এখন ইউপিআই-এর সাথে ক্রেডিট কার্ডের লিংক করা যাওয়ায় ফিজিক্যাল কার্ড ছাড়াই শুধুমাত্র কিউআর কোড স্ক্যান করেই পেমেন্ট করার দরজা খুলে গেছে।
ইউপিআই তে ক্রেডিট কার্ড লিংকের ব্যবস্থাপনার বৈশিষ্ট্য ও সুবিধা
ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট করা মানে আসলে তৎক্ষণাৎ নিজের টাকা খরচ না করে ক্রেডিট কার্ড ইস্যুয়ার কোম্পানির টাকা দিয়ে (ধার করে) পেমেন্ট করা এবং সেই ধার মেটাবার জন্য ৫০ দিন পর্যন্ত সুদবিহীন সময় পেয়ে যাওয়া। ইউপিআই তে ক্রেডিট কার্ড লিংক করলে এই সুবিধার পাশাপাশি আরও যে সমস্ত সুবিধা পাওয়া যায় সেগুলো হলো,
- কেনাকাটা করতে বেরোলে ফিজিক্যাল কার্ড নিয়ে বেরোবার দরকার পড়ে না। এটা এমনিতেই একটা সুবিধা। তাছাড়া এর ফলে একদিকে যেমন কার্ড চুরি হওয়ার বা হারাবার ভয় থাকেনা তেমনই অন্যদিকে কার্ড ইনফরমেশন চুরি হয়ে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না।
- পেমেন্টের সময় ক্রেডিট কার্ড নম্বর, এক্সপায়ারি ডেট, সিভিভি নম্বর, ক্রেডিট কার্ড পিন ইত্যাদি কোনো কিছুই ব্যবহার করার বা মনে রাখার দরকার পড়ে না। শুধু ইউপিআই পিন মনে রাখলেই কাজ চলে যায়।
- ব্যাংক ব্যলেন্স না থাকলেও কেনাকাটা বা অন্যান্য পেমেন্ট করা যায়।
- প্রতি ট্রানজাকশনে রিওয়ার্ড পয়েন্ট বা ক্যাশব্যাক পাওয়া যায়।
- কোনো ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা না গেলে বা কার্ড লিমিট শেষ হয়ে গেলে একই জায়গা থেকে ক্রেডিট কার্ডের বদলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করার সুবিধা বা বিকল্প পাওয়া যায়।
- এই সিস্টেমটা সিম কার্ডের সঙ্গে লিঙ্কড থাকায় ব্যবহারকারীর ফোন বা সিম ছাড়া অন্য কেউ চাইলেও এর ব্যবহার করতে পারেনা। আর ফোন চুরি হলেও ফোনের পাসকোড ও ইউপিআই পিন ছাড়া চোরও কিছু করতে পারেনা। তাই পুরো সিস্টেমটা খুবই নিরাপদ।
- প্রেরককে কোনো অতিরিক্ত চার্জ দিতে হয় না।
- সরাসরি ক্রেডিট কার্ড পেমেন্ট গ্রহন করার জন্য যেখানে সব সময়ই ব্যবসাদারদের এমডিআর চার্জ বহন করতে হয়, সেখানে এক্ষেত্রে ২০০০ টাকা পর্যন্ত ছোট ছোট ট্রানজাকশনের ক্ষেত্রে ব্যবসাদারদের এই চার্জ বহন করতে হয় না। ফলে এটা ব্যবসাদারদের জন্যও লাভজনক হয়।
- প্রেরক এবং প্রাপক দুইয়ের জন্যই পুরো সিস্টেমটা সেটআপ করা, পেমেন্ট করা এবং রিসিভ করা খুবই সহজ।
এর সীমাবদ্ধতা ও অসুবিধা
- এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র রূপে ক্রেডিট কার্ডই ইউপিআই-এর সাথে লিংক করা যায়।
- সব ব্যাংক এখনো পর্যন্ত এই সুবিধা চালু করেনি। আজ পর্যন্ত যে যে ব্যাংক তাদের ক্রেডিট কার্ডে এই সুবিধা নিয়ে এসেছে সেগুলো হলো এসবিআই, এইচডিএফসি, অ্যাক্সিস, আইসিআইসিআই, কোটাক মাহিন্দ্রা, পিএনবি, আইডিএফসি ফার্স্ট, ব্যাংক অফ বরোদা, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং ইন্ডিয়ান ব্যাংক।
- ভিসা বা মাস্টার কার্ডের তুলনায় রূপে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা এখনো নিতান্তই কম।
- এই ব্যবস্থাপনার সাহায্যে কেবলমাত্র পি-টু-এম বা মার্চেন্ট পেমেন্ট করা যায়। অর্থাৎ কেনাকাটার সময় বা যেকোনো ক্ষেত্রে বিল মেটাতেই কেবল এর ব্যবহার করা যায়। অন্য কাউকে টাকা পাঠাতে, কার্ড টু কার্ড পেমেন্ট করতে কিংবা ক্যাশ উইথড্র করতে এর ব্যবহার করা যায় না।
- ইউপিআই-এর দৈনিক সাধারণ ট্রানজাকশন লিমিট এক্ষেত্রও প্রযোজ্য হয়।
- এছাড়া ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার সাধারণ অসুবিধাগুলোও এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। যেমন, ইউপিআই তে এই কার্ড লিংক করে অহরহ পেমেন্ট করতে থাকলে বেশি খরচ করার অভ্যাস তৈরি হয়ে যেতে পারে। পেমেন্ট করতে গিয়ে কার্ডের ক্রেডিট লিমিট ক্রস করলে ওভার লিমিট চার্জ দিতে হতে পারে। এবং সঠিক সময়ে বিল মেটাতে ব্যর্থ হলে পেনাল্টি ও সুদ গুনতে হতে পারে।
- খুব ছোটো ব্যবসাদার যাদের মাসে ৫০০০০ বা তার কম ট্রানজাকশন হয় তাদের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থাপনা প্রযোজ্য নয়।
ইউপিআই তে গ্রহণযোগ্য কিছু রূপে ক্রেডিট কার্ড
ইউপিআই তে যোগ করা যায় এমন কিছু ক্রেডিট কার্ড হল,
- অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক ইন্ডিয়ান অয়েল রূপে
- এইচডিএফসি টাটা নিউ কার্ড
- আইসিআইসিআই কোরাল রূপে
- ব্যাংক অফ বরোদা স্ন্যাপডিল রূপে
- কোটাক আরবেন রূপে
- পিএনবি মিলেনিয়াল রূপে
- ইউনিয়ন ব্যাংক প্ল্যাটিনাম রূপে
ইত্যাদি। এগুলো ছাড়াও আরও অনেক কার্ড সম্বলিত বড় একটা তালিকা এই লিঙ্কে পাবেন।
এই মুহূর্তে যে সমস্ত পেমেন্ট অ্যাপগুলো এই ফিচার সাপোর্ট করে
- এনপিসিআই ভীম
- গুগল পে
- ফোনপে
- পেটিএম
- এইচডিএফসি পেজ্যাপ
- মোবিকুইক
- স্লাইস
কিভাবে ইউপিআই তে ক্রেডিট কার্ড লিঙ্ক করবেন?
- প্রথমত উপরের তালিকা থেকে সাপোর্টেড যেকোনো পেমেন্ট অ্যাপ ডাউনলোড করে একটা অ্যাকাউন্ট বানিয়ে নিতে হবে।
- এরপর অ্যাপ ভেদে অ্যাড অ্যাকাউন্ট, সেটআপ পেমেন্ট মেথড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, অ্যাড নিউ কার্ড ইত্যাদি এধরণের অপশন থেকে রূপে ক্রেডিট কার্ড সিলেক্ট করতে হবে।
- তারপর ব্যাংকের তালিকা থেকে আপনার কার্ডের ইস্যুয়ার ব্যাংক সিলেক্ট করতে হবে।
- অতঃপর আপনার এক একাধিক রূপে কার্ড থাকলে তার তালিকা দেখতে পাবেন। সেই তালিকা থেকে যে কার্ড ইউপিআই এর সঙ্গে যোগ করতে চান সেটা বেছে নিতে হবে।
- সবশেষে কার্ডের শেষ ছয় নম্বর ও এক্সপায়ারি ডেট এন্ট্রি করে ইউপিআই পিন সেট করে নিতে হবে।
এভাবেই ইউপিআই তে ক্রেডিট কার্ড লিংক করা যাবে। পেমেন্ট করার সময় এই প্ল্যাটফর্মে এমনিতে যেভাবে পেমেন্ট হয় সেভাবেই পেমেন্ট হবে, শুধুমাত্র ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বদলে ক্রেডিট কার্ড বেছে নিতে হবে।
শেষ কথাঃ
একদিকে ইউপিআই সিস্টেমটা যেমন যুগান্তকারী তেমনই এর সাথে ক্রেডিট কার্ডের লিংক করাটা আরও এক যুগান্তকারী ব্যবস্থাপনা। এতে লাভ সকলের। একদিকে যেমন এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা খুব সহজে ছোট থেকে শুরু করে বড় সমস্ত রকম ব্যবসা ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধে পাবে, তেমনই ব্যবসাদাররাও খুব সহজেই এই কার্ডের পেমেন্ট নিতে পারবে এবং তাদের ব্যবসা বাড়বে। বেশি বেশি ট্রানজাকশন হওয়ার জন্য কার্ড ইস্যুআর ব্যাংকগুলোরও ব্যবসা বাড়বে। আর এভাবেই পুরো দেশ ক্যাশলেস ইকোনমির পথে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে।
আজ তাহলে এখানেই শেষ করি। ভালো থাকবেন।
ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত অন্যান্য কিছু আর্টিকেল যা ইউপিআই-এর মাধ্যমে এই কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কাজে আসতে পারেঃ
- ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি কিভাবে হয়? এর থেকে বাঁচবেন কিভাবে…?
- এভাবে ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করে 2000 টাকা পর্যন্ত উপহার পান
- ক্রেডিট কার্ডের ব্যাপারে 7 টা ভুল ধারণা বা মিথ – না জানলেই বিপদ
- ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে টাকা বাঁচানোর 20 টি গোপন উপায়
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
ইউপিআই তে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে পেমেন্ট করার জন্য কোন পিন প্রয়োজন?
ইউপিআই পিন
ইউপিআই অ্যাপ থেকে ক্রেডিট কার্ড ব্যালেন্স চেক করা যাবে কি?
হ্যাঁ যাবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতোই ক্রেডিট কার্ড সিলেক্ট করে চেক ব্যালেন্স অপশনে গেলে কার্ডের অ্যাভেলেবেল আর আউটস্ট্যান্ডিং ব্যালেন্স দেখিয়ে দেবে।
সর্বাধিক কতগুলো কার্ড ইউপিআই-তে লিংক করা যাবে?
এধরনের কোনো লিমিটেশন নেই।
একদিনে সর্বাধিক কত টাকার ট্রানজাকশন করা যাবে?
ইউপিআই এর লিমিট অনুযায়ী এক দিনে কিছু ক্ষেত্রে ১ লাখ এবং কিছু ক্ষেত্রে ২ লাখ টাকা অথবা কার্ডের বর্তমান ক্রেডিট লিমিট পর্যন্ত খরচ করা যাবে।