কিছু টাকা আয় করার পর হাতে আসা সেই টাকা বাড়াতে কে না চায়। আর টাকা বাড়ানোর আশাতেই আমরা বিনিয়োগের বিভিন্নরকম রাস্তা খুঁজি যেখানে খরচের পর বেঁচে থাকা অতিরিক্ত টাকা ঢুকিয়ে কিছু অতিরিক্ত লক্ষ্মীলাভ করা যায়।
এই বিনিয়োগের সবথেকে সেরা রাস্তা মনে করা হয় শেয়ার বাজারকেই। কারণ, এখানে রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সবথেকে বেশি। কিন্তু তার সাথে সাথেই এখানে বিনিয়োগের ঝুঁকিও সর্বাধিক।
আবার একটু ঝুঁকি না নিলে সম্ভাবনাটাও হাতছাড়া হয়ে যায়। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার ঝুঁকিগুলো–কে পুরোপুরি এড়ানো যায়না, তবে বিশেষ পরিকল্পনার মাধ্যমে ঝুঁকিগুলো ম্যনেজ করা যায় বা ঝুঁকির আঁচ কিছুটা কমানো যায়।
চলুন তবে এখানে বিনিয়োগের ঝুঁকি কিভাবে কমানো যাবে তার 10 টা উপায় জেনে নেওয়া যাক…
1. নিজের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে
সবার পরিস্থিতি আলাদা এবং তার সাথে তাদের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা বা মনোভাবও আলাদা। সাধারণত বয়স, আয়, জমা টাকা-পয়সা, দায়-দায়িত্ব ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে কারো ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা বা রিস্ক টলারেন্স বেশি বা কম হয়।
যেমন ধরুন 20 বছরের অবিবাহিত চাকুরীজীবী একজনের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা যত হবে 55 বছর বয়সী এক সংসারী ব্যক্তির ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা তার থেকে অনেক কম হবে।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে হলে সবার আগে নিজেকে এবং নিজের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা ভালো করে বুঝে নিতে হবে। তারপরে সেইমতো নিজের বিনিয়োগের কৌশলটা ঠিক করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ ধরে নেওয়া যাক কম ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন কেউ হাই রিস্কের স্মল ক্যাপ স্টক কিনে বসলেন। স্মল ক্যাপ কোম্পানির শেয়ারের ঝুঁকি সব সময়ই বেশি থাকে এবং সব সময়ই এ ধরনের শেয়ারে কম সময়ের মধ্যে অনেক বেশি বাড়ার অথবা কমার সম্ভাবনা থাকে। যাই হোক, কেনার পর ধরে নেওয়া যাক সেই শেয়ারের দাম দুর্ভাগ্যবশত 20% কমে গেল। যেহেতু বিনিয়োগকারিটির বেশি ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা ছিল না, তাই তিনি ভয় পেয়ে ওই শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে 20% ক্ষতির সম্মুখীন হলেন।
একজন বেশি ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতার কেউ যদি ওই শেয়ার কিনতেন, তিনি কিন্তু এতটা দাম পড়ে গেছে দেখে হয় বিচলিত হতেন না এবং আরো অপেক্ষা করতেন ভবিষ্যতে দাম আবার ঠিকঠাক জায়গায় চলে আসার অথবা দাম এতটা পড়ে যাওয়ার আগেই বিক্রি করে দিয়ে ক্ষতির অংকটা কম রাখতেন।
2. নিজের লক্ষ্য পরিষ্কার হতে হবে
বিনিয়োগ করার পিছনে নিজের লক্ষ্য কি সেটার একটা পরিষ্কার ছবি মনের মধ্যে তৈরি করে নিতে হবে। তাহলেই কোথায়, কিভাবে বা কত বিনিয়োগ করবেন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে তথা ঝুঁকি কমবে।
ধরুন আপনি এক-দু’বছর পরে বিদেশে বেড়াতে যেতে চান এবং সেজন্য কিছু টাকা জমানো আপনার লক্ষ্য। তো এক্ষেত্রে আপনাকে কম ঝুঁকির কোনো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে নয়তো এই স্বল্প সময়ের পরে যখন আপনার টাকাটার প্রয়োজন পড়বে তখন সেই টাকাটা হাতে পেতে সমস্যা হতে পারে।
আবার ধরুন ছেলে-মেয়ের উচ্চশিক্ষার জন্য কুড়ি বছরের লম্বা সময় ধরে একটা ফান্ড বানাতে চান। লং টার্ম ইনভেস্টমেন্ট হওয়ার জন্য আপনি এক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকি সম্পন্ন কোথাও বিনিয়োগ করতে পারেন যাতে লম্বা সময়ে বেশি রিটার্ন পেতে পারেন।
3. বিনিয়োগ করার আগে নিজে সবরকম তত্ত্বানুসন্ধান করতে হবে
মনে রাখতে হবে বিনিয়োগ করার সময় আপনি নিজের টাকা বিনিয়োগ করছেন এবং বিনিয়োগে ক্ষতি হলে সেটা আপনাকেই হজম করতে হবে। সুতরাং যেখানেই বিনিয়োগ করুন, বিনিয়োগ করার আগে যে কোম্পানিতে বা যে ইন্সট্রুমেন্টে বিনিয়োগ করতে চাইছেন সেটার ব্যাপারে দায়িত্ব সহকারে ভালো করে সবকিছু অনুসন্ধান করলে তবেই বিনিয়োগের ঝুঁকি কম হবে।
অন্যের পরামর্শ বা টিপসের উপর ভরসা করে বিনিয়োগ করা সব থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনার আগে কিছু প্রশ্নের উত্তর ভালো করে জেনে নেওয়া উচিত, যেমনঃ
- কোম্পানিটা কত বড়?
- ওই ব্যবসা আপনি বোঝেন কি?
- ওদের প্রোডাক্ট বা সার্ভিস এখন থেকে দশ কুড়ি বছর পরেও প্রাসঙ্গিক থাকবে কি?
- কোম্পানিটার কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ আছে?
- বছরের পর বছর ব্যবসা বাড়ছে কি?
- ডিভিডেন্ড কিরকম দেয়?
- শেয়ারহোল্ডিং প্যাটার্ন কিরকম?
- প্রোমোটাররা বা মিউচুয়াল ফান্ড হাউস গুলো ওই কোম্পানির শেয়ার কিনছে না বেচছে?
- ম্যানেজমেন্ট কিরকম?
- কোনো গন্ডগোলের ইতিহাস আছে নাকি?
- ওই শেয়ার সম্পর্কিত বিভিন্ন ফিনান্সিয়াল অনুপাত গুলো কেমন? যেমন,
- বিগত পাঁচ বছরে আরনিং পার শেয়ার বা ইপিএস বাড়ছে কি?
- প্রাইস টু আর্নিং রেশিও বা পিই এবং প্রাইস টু বুক রেশিও বা পিবি প্রতিযোগী এবং ইন্ডাস্ট্রি অ্যাভারেজের থেকে কম কি?
- ডেট টু ইকুইটি রেশিও এক বা হাফ এর থেকে কম কি?
- তিন বছরের রিটার্ন অন ইকুইটি বা আরওই 15%-এর থেকে বেশি কি?
এসব ছাড়াও আরো অনেক কিছুই জানার থাকে তবে সবকিছু জানতে আপনাকে নিজেকেই মাঠে নামতে হবে।
4. বিনিয়োগ বৈচিত্র্যময় বা ডাইভারসিফাই করতে হবে
কথায় আছে, এক ঝুড়িতে নিজের সব কটা ডিম রেখো না। কারণ ঝুড়ি যদি কখনো পড়ে যায় তাহলে একসাথে সব কটা ডিম ভেঙে যাবে। একই রকম ভাবে, একটা শেয়ারে বা এক ধরনের ইন্সট্রুমেন্টেই যদি আপনার পুরো ক্যাপিটাল বিনিয়োগ করে দেন সেক্ষেত্রে ওই একটা জিনিসের পতন আপনার পুরো ক্যাপিটালকে বিপদের মুখে ফেলে দিতে পারে। তাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকি কম করার একটা খুব ভালো উপায় হচ্ছে পুরো ক্যাপিটাল একাধিক ঝুড়িতে ভাগ করে রাখা বা ডাইভারসিফিকেশন।
ইকুইটিতে বিনিয়োগ করতে চাইলে একাধিক সেক্টরের বিভিন্ন মার্কেট ক্যাপের একাধিক শেয়ার কেনা উচিত। নিজে নিজে ডাইভারসিফাই করা জটিল মনে হলে ইকুইটি ইটিএফ বা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।
আর ডাইভারসিফিকেশন মানে শুধুমাত্র আলাদা আলাদা শেয়ার কেনা নয়, বিনিয়োগের বিভিন্ন অন্যান্য বিকল্পেও ক্যাপিটালের কিছু অংশ বিনিয়োগ করা।
বিনিয়োগে বৈচিত্র আনলে আপনার বিনিয়োগের কোনো এক ক্ষেত্রে নেগেটিভ রিটার্ন দিলেও অন্য ক্ষেত্রের পজিটিভ রিটার্ন দিয়ে সেটাকে ব্যালেন্স করে নেওয়া যায়।
আবার বিনিয়োগের কিছু কিছু বিকল্প অন্য কিছু বিকল্পের উল্টো ফল দেয়। যেমন শেয়ার বাজার যখন ওঠে তখন সাধারণত সোনার দাম কমে আর শেয়ার বাজার পড়লে সোনার দাম বাড়ে। তাই আপনি আপনার পোর্টফোলিওতে যদি সোনাও অন্তর্ভুক্ত করেন তাহলে শেয়ারবাজারে ধস নামলে সোনায় বিনিয়োগ-এর লাভ শেয়ারের ক্ষতিটাকে কিছুটা কমিয়ে দিতে সাহায্য করবে।
সম্পর্কিতঃ বিনিয়োগে ডাইভারসিফিকেশন কী? কেন? কিভাবে?
5. পোর্টফোলিওতে যথেষ্ট লিকুইডিটি বজায় রাখতে হবে
পোর্টফোলিওর কিছুটা পার্ট এমন কিছুতে বিনিয়োগ করতে হবে যাতে দরকার পড়লেই রিডিম করে ক্যাশ পাওয়া যেতে পারে বা কিছুটা ক্যাশ সবসময় এমার্জেন্সি ফান্ড হিসাবে সাইডে রাখতে হবে।
শেয়ারবাজারে বড় কোনো পতন হলে এই লিকুইডিটি বা ক্যাশ ব্যবহার করে যেমন কম দামে আরো শেয়ার কেনা যাবে বা এভারেজিং করা যাবে তেমনি আবার হঠাৎ কোনো এমারজেন্সিতে টাকার দরকার পড়লে আসল লং টার্ম ইনভেস্টমেন্ট গুলোতে সঠিক সময়ের আগে বা অনুপযুক্ত সময়ে হাত দেওয়ার দরকার পড়বে না।
6. কিছু উচ্চ ডিভিডেন্ড প্রদানকারী শেয়ার বেছে নেওয়া যেতে পারে
কোম্পানিগুলো তাদের অতিরিক্ত লভ্যাংশ ডিভিডেন্ড রূপে শেয়ার হোল্ডারদের সময়ে সময়ে বিতরণ করে। আর এ ধরনের শেয়ার সাধারণত হাই কোয়ালিটিরই হয়।
তাই ইকুইটিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এইধরনের কিছু শেয়ার বেছে নিলে বাজার ভালো চলুক বা খারাপ, ডিভিডেন্ডের মাধ্যমে কিছু এক্সট্রা ইনকাম হয়ে যায় আর ওভারঅল রিটার্নের হারও বেড়ে যায়।
7. একবারে পুরো ক্যাপিটাল বিনিয়োগ না করে ধাপে ধাপে বিনিয়োগ করতে হবে
আপনার কাছে যা ক্যাপিটাল আছে তার মধ্যে আপনি যতটা শেয়ার বাজারে ঢালতে চান ততটা একবারে ঢুকিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। পুরো ক্যাপিটাল টা ধাপে ধাপে যদি ঢোকানো হয় সেক্ষেত্রে বিনিয়োগের ঝুঁকি কম হয়। কারণ ধাপে ধাপে বিনিয়োগ করলে মার্কেট উঠুক বা পড়ুক কিছুটা অ্যাভারেজিং হয়ে যায়।
আর এটা করার জন্য সিস্টেমেটিক ইনভেসমেন্ট প্ল্যান বা এসআইপির সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে।
8. শেয়ার কেনার সঠিক সময়ের উপর ফোকাস না করে কতটা সময় ইনভেস্টেড থাকা হবে সেটায় ফোকাস করতে হবে
শেয়ার বাজার এমনিতে সবসময়ই কখনো ওঠে আর কখনও পড়ে। তাই এখানে বিনিয়োগের সঠিক সময় বা মুহূর্ত খোঁজার থেকে ভালো শেয়ারে নিয়মিত বিনিয়োগ করা এবং বিনিয়োগ করার পর লম্বা সময়ের জন্য হোল্ড করে থাকা এখানে বিনিয়োগের ঝুঁকি কমানোর একটা উত্তম উপায়।
9. বিনিয়োগের উপর নিয়মিত নজর রাখতে হবে
বিনিয়োগ করার পর বা শেয়ার কেনার পর সেটার ব্যাপারে ভুলে গেলে চলবে না। নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে বিনিয়োগের বর্তমান অবস্থার ওপর নজর রাখা বিনিয়োগে ঝুঁকি কমানোর জন্য জরুরী।
আজকাল ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে খবর ছড়ায়, পরিস্থিতি বদলায়, শেয়ারবাজার ও শেয়ারের দাম ওঠানামা করে তড়িৎ গতিতে। তাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলে এই বাজার সংক্রান্ত ঘটনাবলীর উপর এবং নিজের পোর্টফলিওর পারফরম্যান্সের উপর নজর রাখাটা অত্যাবশ্যক।
10. আবেগপ্রবণ না হয়ে মাথা খাটিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে
শেয়ারবাজারে আবেগের কোন জায়গা নেই। কিংবদন্তি ইনভেস্টার রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার কথায়, ‘আবেগের বশবর্তী হয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা মানে ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী।’ আপনি যতই আবেগ তাড়িত হয়ে ভাবুন অমুক শেয়ারটার দাম বাড়বে বা অমুক শেয়ার এখন কমলেও পরে ঠিক রিকভার হয়ে যাবে, শেয়ার বাজার কিন্তু কখনোই আপনার এই আবেগের মর্যাদা দেবে না। আর এভাবে আবেগ তাড়িত হয়ে শেয়ার বাজারে কিছু করার সিদ্ধান্ত নেয়া মানে ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়া।
তাই এখানে এক পাও এগোতে গেলে সেটা হতে হবে নিজের শিক্ষণের উপর নির্ভর করে, বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করে, সংখ্যার উপর নির্ভর করে এবং যুক্তির উপর নির্ভর করে।
বোনাস
এছাড়াও শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের ঝুঁকি কমানোর জন্য,
- বড় বড় কোম্পানির শেয়ার কেনা যেতে পারে। কারণ বড় বড় কোম্পানির ব্যালেন্স শিট সাধারণত ঠিকঠাক থাকে এবং শেয়ারের দাম ধীরে হলেও সাধারণত ক্রমাগত বাড়ে এবং শেয়ার বাজারের ধস নামলেও এই ধরণের শেয়ারের দাম সাধারণত খুব বেশি হেরফের হয়না।
- বড় বড় ইনভেস্টার-দের পরামর্শ ফলো করা যেতে পারে কারণ তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অতুলনীয়।
- এই ব্লগ নিয়মিত ফলো করা যেতে পারে কারণ শেয়ার বাজার সংক্রান্ত অনেক কিছুই এখানে জানা যায়।
শেষ কথা
শেয়ার বাজার একটা সমুদ্রের মতো। এখানে টাকা কামাবার বা টাকা বাড়াবার উপায় অনেক। তবে ঝুঁকি গুলো এড়িয়ে কিছু ভালো ফল পেতে হলে সবার আগে দরকার ভালো করে জানা, বোঝা ও শেখা।
Khub sundor lekha. Anek kichu ache ja sadharon manus Jane na. Publish korar jonno dhonnobad.