শেয়ার বাজারের ব্যাপারে আমার একটাই কথা মাথায় আসে, ‘ইয়ে চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত’। আমার সবথেকে প্রিয় বাজার এটাই। কত রকমের কোম্পানির, কম-বেশি কত রকম দামের শেয়ার এখানে প্রতিদিন কেনাবেচা হয়।
শেয়ারবাজার খুবই আনপ্রেডিক্টেবল, ঝুঁকিপূর্ণ এবং গোলকধাঁধার মতো। ইনডেক্স হোক বা কোনো বিশেষ শেয়ারের দাম হোক, বিভিন্ন কারণে অনবরত ওঠানামা করে। কিন্তু তার মাঝেও এই শেয়ার কেনাবেচা করেই অনেক সাধারণ মানুষও অসাধারণে পরিণত হয়েছেন। আর সেসব দেখেই কত লোক প্রতিদিন এখানে ঢুঁ মারতে আসেন বড়লোক হওয়ার অভিপ্রেত নিয়ে। তার মধ্যে কেউ সফল হন আবার কেউ বা সব হারান।
কিন্তু শেয়ার বাজারের আকর্ষণ চির অমলিন হয়ে থাকে। আর সেই আকর্ষণের জন্যই পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শেয়ার বাজারে ইনভেস্টার ও ট্রেডাররা নিয়মিত অংশ নেন।
ভারতীয় শেয়ার বাজার, যা এখন মার্কেট ক্যাপ-এর ভিত্তিতে পৃথিবীর সব দেশের মধ্যে পঞ্চম, এর ব্যাতিক্রম নয়। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশের অন্যান্য সব ক্ষেত্রের মতো, এটাও বড় যেমন হয়েছে তেমনই এতে অনেক রকম পরিবর্তনও হয়েছে। আজকের দিনে ভারতীয় শেয়ারবাজার ও এখানে অংশগ্রহণকারীরা অনেক বেশি পরিণত।
এই ভারতীয় শেয়ারবাজার সম্পর্কিত 10 টা অজানা চমকপ্রদ তথ্য এবং ঘটনার ব্যাপারে এখানে জানতে পারবেন।
তথ্য #1 এশিয়ার সবথেকে পুরানো এবং পৃথিবীর সবথেকে বড় এক্সচেঞ্জ
ভারতের সবথেকে বড় ও পরিচিত দুই এক্সচেঞ্জের মধ্যে বিএসই শুধু ভারতের না, এশিয়ার সবথেকে পুরানো এক্সচেঞ্জ। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ নামে এক ব্যবসায়ী উনিশ শতকে এর প্রতিষ্ঠা করেন। এখন এই এক্সচেঞ্জে 5000-এরও বেশি কোম্পানি লিস্টেড আছে। আর এই সংখ্যার বিচারে এখন এই এক্সচেঞ্জ পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বড়।
তথ্য #2 অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতীয় শেয়ারবাজারের বৃদ্ধি
বিগত 20 বছরে যেখানে আমেরিকার শেয়ার বাজার বেড়েছে 907% এবং ইংল্যান্ডের শেয়ার বাজার বেড়েছে মাত্র 46% সেখানে ভারতের সেন্সেক্স বেড়েছে 1792%!
তথ্য #3 শেয়ারবাজারে অংশগ্রহণকারী ভারতীয়
করোনা আসার পর ভারতীয় শেয়ার বাজারে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও এখনও পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার 4% এর থেকেও কম লোক এখানে অংশ নিয়েছেন। আরও একটা বিশেষ ব্যাপার হচ্ছে এইসব অংশগ্রহণকারীর মধ্যে বেশিরভাগই মুম্বাইবাসী। যাইহোক, শুনলে অবাক হবেন, আমারিকায় 55% এরও বেশি মানুষ সেখানের শেয়ার বাজারের সঙ্গে যুক্ত। মানে ধরে নেওয়া যায় যত দিন যাবে ক্রমশ ভারতের আরও লোক শেয়ারবাজারে অংশ নেবেন এবং তাদের সঞ্চিত টাকা এখানে বিনিয়োগ করবেন আর তার সাথে সাথে এটা আরও বড় হবে।
তথ্য #4 আমেরিকার ন্যাসড্যাক এক্সচেঞ্জে লিস্ট হওয়া প্রথম ভারতীয় কোম্পানি
আমেরিকার ন্যাসড্যাক এক্সচেঞ্জে লিস্ট হওয়া প্রথম ভারতীয় কোম্পানি হচ্ছে ইনফোসিস। ইনফোসিস লিমিটেড ভারতের এক অন্যতম মাল্টিন্যাশনাল আইটি কোম্পানি। এই কোম্পানি ভারতের সবথেকে বড় 10 টা কোম্পানির মধ্যে একটা। 1999 সালের মার্চ মাসে এই কোম্পানি আমেরিকার ন্যাসড্যাক ইনডেক্সে স্থান করে নেয়। এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল 1981 সালের জুলাই মাসে আর ভারতীয় শেয়ার বাজারে এর লিস্টিং হয়েছিল 1992 সালের জুন মাসে।
তথ্য #5 ভারতীয় শেয়ারবাজারের সবথেকে দামী শেয়ার
ভারতীয় শেয়ার বাজারের সবথেকে দামী শেয়ার মাদ্রাজ রবার ফ্যাক্টরি বা এম আর এফ। এটা ভারতের সবথেকে বড় টায়ার তৈরির কোম্পানি।
1946 সালে কে এম ম্যামেন ম্যাপিল্লাই মাদ্রাজে এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খেলনা বেলুন তৈরির কারখানা হিসেবে। 1952 সালে এই কোম্পানি টায়ার তৈরি শুরু করেছিল। 1967 সালে প্রথম ভারতীয় কোম্পানি হিসাবে এই কোম্পানি আমেরিকায় টায়ার রপ্তানি করেছিল।
এই মুহূর্তে এর একটা শেয়ারের দাম 88800 টাকারও বেশি। 1993 সালের 27শে এপ্রিল এমআরএফ শেয়ারবাজারে লিস্টেড হয়েছিল এবং সেদিন এর একটা শেয়ারের দাম ছিল 11 টাকা। সে সময়ে এই শেয়ারে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে এখন তার ভ্যালু 80 কোটিরও বেশি হতো।
তথ্য #6 ভারতীয় জনসাধারণের শেয়ারবাজারে অনুরক্তি যখন শুরু হয়
1977 সালে ধীরুভাই আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিসের আইপিও হওয়ার সাথে সাথে ভারতে আমজনতার শেয়ারবাজার এবং শেয়ার কেনাবেচার প্রতি প্রকৃত অনুরক্তি শুরু হয়। সে সময়ে শেয়ার বাজারের মধ্যমণি হয়ে ওঠে রিলায়েন্স। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই কোম্পানি ফুলেফেঁপে যেমন ভারতের সবথেকে বড় কোম্পানি হয়ে উঠেছে তেমনি এর শেয়ারহোল্ডারদেরও দারুন রিটার্ন দিয়েছে। বিগত 25 বছরে এই কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের গড়ে বাৎসরিক 22% রিটার্ন দিয়েছে।
তথ্য #7 1982 তে রিলায়েন্সের শর্ট সেলিং
1982-র সময়ে শেয়ার বাজারে সেটেলমেন্ট পিরিয়ড ছিল 14 দিনের। মানে 14 দিনের মধ্যে কোনো শেয়ার কেনা-বেচা করলে সেটা ইন্ট্রাডে ট্রেড হিসেবে ধরা হতো। অনেকে এই জিনিসটা ব্যবহার করে 14 দিনের জন্য শেয়ার শর্ট সেল করে লাভ করার চেষ্টা করতেন।
সাম্প্রতিককালে যেমন হিন্ডেনবার্গ শর্ট সেলার আদানির শেয়ার টার্গেট করে নেগেটিভ সেন্টিমেন্ট তৈরি করার মাধ্যমে শর্ট সেল করে লাভ করার চেষ্টা করেছে, ঠিক সেভাবেই ওই সময়েও বিয়ার কার্টেল গুলো বিভিন্ন শেয়ার টার্গেট করে এবং ক্রমাগত শর্ট সেল করে শেয়ারের দাম ফেলে দিয়ে লাভ করার চেষ্টা করত।
বাংলার এক বিয়ার কার্টেল ওইসময় রিলায়েন্সের শেয়ার টার্গেট করে এবং খুব সময়ের মধ্যে 11 লাখ শেয়ার শর্ট সেল করে শেয়ারের দাম অনেকটা ফেলে দেয়। ধীরুভাই আম্বানি জিনিসটা বুঝতে পেরে ওনার ব্রোকার বন্ধুদের সে সময়ে রিলায়েন্সের শেয়ার কিনতে বলেন।
14 দিনের সেটেলমেন্ট পিরিয়ডের পর বিয়ার কার্টেলের যখন শেয়ার ডেলিভারি দেওয়ার সময় আসে তখন তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়। এবং আম্বানি বাবু ট্রেড সেটেল হওয়া পর্যন্ত শেয়ার বাজার ওপেন হতেই দেননি। যার ফলে সে সময়ে তিন দিনের জন্য বাজার বন্ধ থাকে।
তথ্য #8 স্ক্যাম 1992
হর্ষদ মেহেতা বোম্বের একজন স্টক ব্রোকার ছিলেন। 1990 এর দশকের গোড়ার দিকে ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ এর লুপহোল গুলোকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার লোন নিয়ে শেয়ার মার্কেটে ঢুকিয়ে কৃত্রিমভাবে বিভিন্ন শেয়ারের দাম 44 গুন পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন। তারপর এই অস্বাভাবিক দামে শেয়ার বেচে তিনি মুনাফা লোটেন।
সেন্সেক্স সে সময় 1000 থেকে 4500-এ উঠে যায় খুব কম সময়ের মধ্যেই। তার জন্যই সে সময়ে মাত্র দু-তিন মাসের মধ্যে এসিসি কোম্পানির শেয়ারের দাম 200 থেকে বেড়ে 9000 হয়ে যায়।
হর্ষদ মেহেতা স্ক্যাম-এর আনুমানিক পরিমাণ ছিল 4000 কোটির মতো যা এখনকার বাজার মূল্য অনুযায়ী প্রায় 20000 কোটি।
এই স্ক্যাম প্রকাশ্যে আসার পর সেন্সেক্স আগামী এক বছরে প্রায় 50% পড়ে যায় এবং আগামী দু’বছর ভারতের শেয়ার বাজারে বিয়ারিশ সেন্টিমেন্ট বজায় থাকে।
এরপরই সরকার নড়েচড়ে বসে এবং শেয়ার বাজার রেগুলেট করার জন্য ও নজরদারি চালানোর জন্য সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া বা সেবি গঠন করা হয়।
তথ্য #9 একটা ভারতীয় কোম্পানি করাচি স্টক এক্সচেঞ্জের মোট মার্কেট ক্যাপ-এর থেকে বেশি বড়
ভারতের সব থেকে বড় দুই কোম্পানি মানে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিস এবং টিসিএস-এর যা মার্কেট ক্যাপিটাল তা পাকিস্তানের করাচি স্টক এক্সচেঞ্জে লিস্টেড সমস্ত কোম্পানির সমষ্টিগত মার্কেট ক্যাপিটাল এর থেকেও বেশি।
তথ্য #10 ভারতের হরেক এক্সচেঞ্জ
ভারতের সবথেকে বড় দুই এক্সচেঞ্জ হল —
- বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ বা বিএসই এবং
- ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ বা এনএসই
এছাড়াও এখানে আরো পাঁচ এক্সচেঞ্জের অস্তিত্ব আছে। যথাঃ
- ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জ
- মেট্রোপলিটন স্টক এক্সচেঞ্জ অফ ইন্ডিয়া
- মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ অফ ইন্ডিয়া বা এমসিএক্স
- ন্যাশনাল কমোডিটি অ্যান্ড ডেরিভেটিভস এক্সচেঞ্জ
- ইন্ডিয়ান কমোডিটি এক্সচেঞ্জ
বোনাসঃ 72-এর নিয়ম
যখন ছোট ছিলাম তখন দেওয়াল লিখনে দেখতাম অমুক জায়গায় বিনিয়োগ করলে পাঁচ বছরে টাকা ডবল। যদিও এখন এ ধরনের অ্যাড খুব একটা দেখা যায় না কারণ সুদ এখন এতই কমে গেছে যে এই বছরের সংখ্যাটা এখন অনেক বেশি হয়ে যায়। তাই ওই বছরের সংখ্যা দিয়ে এখন আর মন ভোলানোর চেষ্টা করা হয় না।
যাইহোক, যখনই এ ধরনের কোনো ট্যাগলাইন দিয়ে বিনিয়োগের কোনো ইন্সট্রুমেন্ট কে প্রমোট করা হয় বা ‘এক্স বছরে টাকা ডবল’ -এ ধরনের কথা বা প্রশ্ন সামনে আসে, তখনই এই 72-এরনিয়মকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই ওই বিনিয়োগে যত শতাংশ সুদের কথাটা উহ্য রাখা হচ্ছে বা অন্তর্নিহিত সুদের হার যতো সেটার মোটামুটি একটা হিসেব পাওয়া যায়।
এই নিয়মে 72 কে ওই বছরের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে যেটা আসে সেটাই হচ্ছে অ্যাপ্রক্স সুদের মান। মানে পাঁচ বছরের ডবল হচ্ছে যেখানে সেখানে সুদ 72/5=14.4 । সুতরাং যেটা দেখা যাচ্ছে এক্ষেত্রে সুদের হার মোটামুটি 14%।
একইভাবে যদি ইন্টারেস্ট বা বৃদ্ধির হার জানা থাকে তাহলে কত বছরে আপনার বিনিয়োগ ডবল হবে সেটাও হিসেব করা যায়। এখনকার 7% ব্যাংক ইন্টারেস্ট অনুযায়ী 72/7= 10.3 বা মোটামুটি 10 বছরে টাকা ডবল হবে। আবার ধরুন একটা শেয়ারের দাম বিগত 5 বছরে 10% হারে বেড়েছে। আগামী দিনেও এই হারে বাড়বে ধরে নিলে আপনি খুব সহজেই হিসেব করে নিতে পারবেন যে ওই শেয়ার কিনলে টাকা ডবল হতে 72/10=7.2 বা মোটামুটি 7 বছর সময় লাগবে।
শেষ করার আগে…
আশা করি উপরে দেওয়া তথ্যগুলো ভারতীয় শেয়ার বাজারের ব্যাপারে আপনার জানার পরিধিকে একটু হলেও বাড়াবে। আজ তাহলে এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকবেন। 🙂