শেয়ার বাজারের সাথে ক্যান্ডেলস্টিক চার্ট ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ট্রেডাররা সমস্ত রকম ট্রেডিং-এর জন্য টেকনিক্যাল অ্যানালিসিস করতে এ ধরনের চার্টেরই ব্যবহার করে থাকেন। বেশীরভাগ ট্রেডিং টার্মিনালে এবং শেয়ার বাজার সম্পর্কিত অনেক ওয়েবসাইটে (যেমন ট্রেডিংভিউ) সমস্ত শেয়ার এবং যেকোনো ইনডেক্সের ডিফল্ট চার্ট হিসাবে এই চার্টই দেখানো হয়। কিন্তু এই ক্যান্ডেলস্টিক চার্ট আসলে কী? এর অর্থই বা উদ্ধার করে কিভাবে?
এধরণের চার্ট সম্পর্কিত এই সমস্ত কিছুই আপনি এই আর্টিকেলে জানতে পারবেন।
চার্ট কী?
ক্যান্ডেলস্টিক চার্ট সম্পর্কে জানার আগে সবার প্রথমে জানতে হবে এই ‘চার্ট’ কী জিনিস। এখানে যে চার্টের কথা বলা হচ্ছে তাকে অনেকসময় গ্রাফ-ও বলা হয়। বোরিং দুর্বোধ্য ডেটা বা ইনফর্মেশন সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যে সুন্দরভাবে গ্রাফিক্যালি বা ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার জন্যই চার্টের ব্যবহার করা হয়। বিভিন্নরকম চার্টে ডেটা গুলোকে বিভিন্নরকম প্রতীক যেমন লাইন, বার, স্লাইস ইত্যাদির মাধ্যমে দেখানো হয়। আর এই প্রতীক গুলো অনুযায়ী চার্ট গুলোকে বিভিন্নরকম নামে আখ্যায়িত করা হয় যেমন লাইন চার্ট, বার চার্ট, পাই চার্ট ইত্যাদি।
লাইন চার্ট
শেয়ার বাজারে যখন ক্যান্ডেলস্টিক চার্ট ছিলনা তখন ছিল লাইন চার্ট। প্রতি মাসের, সপ্তাহের, দিনের, ঘণ্টার, মিনিটের বা অন্য কোনও সময়ের ব্যবধানে শেয়ারের দামের পরিবর্তনের গ্রাফিকাল উপস্থাপনার জন্যই এই চার্টের ব্যবহার করা হত। করা হত বললে ভুল হবে, এখনও করা হয় এবং ক্যান্ডেলস্টিক চার্টের পাশাপাশি এর ব্যবহার এখনও চলে। যেকোনো ইনডেক্স বা শেয়ারের নামে গুগল করলে সরাসরি গুগলেই এই চার্ট দেখায়। এধরণের চার্টে শেয়ার বাজারে যেকোনো ইন্সট্রুমেন্টের একটা নির্দিষ্ট টাইমফ্রেমে বা সময়ের ব্যবধানে দামের উপরনিচ একটা লাইনের মাধ্যমে উপস্থাপনা করা হয়।
এটা তুলনামূলকভাবে কম জটিল। এতে ইনফরমেশনও ক্যান্ডেলস্টিক চার্টের থেকে কম দেখানো হয়। এধরণের চার্টে নির্দিষ্ট সময়ের শেষে কোনও শেয়ারের যে দাম থাকে (Closing Price) কেবলমাত্র সেই দাম অনুযায়ী দামের পরিবর্তনের লাইনটা ফুটিয়ে তোলা হয়।
ছোটবেলায় স্কুলে গ্রাফ পেপারের কাজ আমরা সকলেই শিখেছি। একটা গ্রাফ পেপারের এক্স অক্ষ বরাবর সময় এবং ওয়াই অক্ষ বরাবর দাম ধরে নির্দিষ্ট সময় (যেমন 1 মিনিট, 15 মিনিট, 1 ঘণ্টা, 1 দিন ইত্যাদি) অন্তর সেই সময়ের শেষে ক্লোজিং প্রাইসগুলোকে একটা বিন্দুর মাধ্যমে নির্দেশ করে বিন্দুগুলোকে যোগ করলেই লাইন চার্ট তৈরি হয়।
ক্যান্ডেলস্টিক চার্ট
এই চার্টে লাইন চার্টের মতো ক্লোজিং প্রাইস ছাড়াও অতিরিক্ত আরও তিনটে তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে যথা, শুরুর দাম (Opening Price), সর্বোচ্চ দাম (Highest Price) আর সর্বনিম্ন দাম (Lowest Price)। যেকোনো কোম্পানির শেয়ারের দামের বা নিফটি ৫০ -র মতো কোনো ইনডেক্সের পয়েন্টের নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেমে পরিবর্তনের চাক্ষুষ উপস্থাপনার জন্য এই ধরণের চার্টের থেকে ভালো আর কোনও বিকল্পের অস্তিত্ব নেই।
টাইম ফ্রেম বা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানঃ একটু আগেও এব্যাপারে উল্লেখ করেছি, আবারও বলছি, শেয়ার বাজারের সব ধরণের চার্টেই সময়ের একটা নির্দিষ্ট ব্যবধান বা টাইম ফ্রেমকে একক হিসাবে ধরে নিয়ে সেই সময়ের শেষে (কখনও শুরু ও মাঝের সময়েও) দামের পরিবর্তনটাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। যেকোনো চার্ট দেখার সময় এই টাইম ফ্রেম বদলে নিয়ে একই জিনিস আলাদা আলাদা টাইম ফ্রেমে কিরকম দেখাচ্ছে সেটা দেখে নেওয়া যায়। বড় টাইম ফ্রেমে ওভারঅল একটা বড় ছবি পাওয়া যায় আর ছোট টাইম ফ্রেমে আরো খুঁটিনাটি পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়। এই টাইম ফ্রেম বড়র দিকে 1 বছর থেকে শুরু করে 1 মাস, 1 সপ্তাহ, 1 দিন, 4, 3, 2, 1 ঘণ্টা, 75, 45, 30, 15, 10, 5, 3, 2 এমনকি 1 মিনিট পর্যন্ত হতে পারে ছোটর দিকে । এমনকি কিছু কিছু টার্মিনাল 30 সেকেন্ডের চার্ট দেখারও সুযোগ দেয়!
ইতিহাস
মনে করা হয় 1700 – 1800 শতকে জাপানে চাল ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রথম এর ব্যবহার শুরু হয়। 1990-এর দশকে আমেরিকায় এর সুত্রপাত হয় এবং ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীব্যাপী শেয়ার বাজারে ট্রেডার ইনভেস্টারদের মধ্যে এই ধরণের চার্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ক্যান্ডেলস্টিক
একটা ক্যান্ডেলস্টিক চার্ট অসংখ্য ক্যান্ডেলস্টিক নিয়ে তৈরি। যেকোনো টাইম ফ্রেমে শেয়ারের দামের চারটে লেভেল বা স্তর যথা শুরুর দাম (Opening Price), শেষের দাম (Closing Price), সর্বোচ্চ দাম (Highest Price) আর সর্বনিম্ন দাম (Lowest Price) এক একটা ক্যান্ডেলস্টিকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়।
এই চারটি লেভেল ঠিকভাবে বোঝানোর জন্য প্রত্যেকটা ক্যান্ডেলস্টিকে দুটো অংশ থাকে। যথা,
মাঝের মোটা বডিঃ
এটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেমে ওপেনিং ও ক্লোজিং প্রাইসের দামের তফাৎটাকে নির্দেশ করে।
দাম বেড়েছে এমন বা বুলিশ ক্যান্ডেলস্টিকে নীচের প্রান্ত ওপেনিং ও উপরের প্রান্ত ক্লোজিং আর দাম কমেছে এমন বা বিয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিকে এর বিপরীত হয়, মানে উপরের প্রান্ত ওপেনিং ও নীচের প্রান্ত ক্লোজিং প্রাইস নির্দেশ করে।
বুলিশ ক্যান্ডেলস্টিকের বডির রঙ সাধারণত সবুজ (কখনও আবার কালো বা ভরাট) হয় আর বিয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিকের বডির রঙ সাধারণত লাল (কখনও আবার সাদা বা ফাঁকা) হয়।
শ্যাডো বা উইকঃ
বডির উপরে ও নীচে দুটো শ্যাডো বা উইক থাকে যার প্রান্ত দুটো একই টাইম ফ্রেমে যথাক্রমে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দাম নির্দেশ করে। তবে দামের পরিবর্তনের ধরণ অনুযায়ী উইক দুটো সব সময় নাও থাকতে পারে।
উদাহরণঃ
নীচের ছবিটা আজকের তারিখে (15/03/23) 15 মিনিটের টাইম ফ্রেমে আদানি এন্টারপ্রাইজের দুটো থেকে তিনটে ত্রিশ পর্যন্ত ছটা ক্যান্ডেলস্টিকের ছবি।
এখানে প্রথম ক্যান্ডেলস্টিকের সময়কাল 2:00 থেকে 2:15। মানে এটা তৈরি হওয়া শুরু হয় 2:00:00 টো থেকে এবং উপর নীচে করতে করতে সম্পূর্ণ তৈরি হয় বা ক্লোজ হয় 2:14:59 তে। এর বডির রং সবুজ, তাই এর ওপেনিং প্রাইস নির্দেশ করছে এর বডির নিচের প্রান্ত, মানে 1837 টাকা এবং ক্লোজিং প্রাইস নির্দেশ করছে উপরের প্রান্ত, মানে 1860.10 টাকা।
এর নিচের উইকের প্রান্তের লেভেল 1828 টাকা। মানে এই পনেরো মিনিটের মধ্যে দাম কখনো না কখনো সর্বনিম্ন এই দামে একবার হলেও নেমেছিল।
একইভাবে উপরের উইকের প্রান্তের লেভেল 1875 টাকা, যা বোঝায় এই সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ দাম কখনো না কখনো একবার হলেও 1875 টাকায় উঠেছিল।
এই ছবির প্রথম ক্যান্ডেলস্টিক 1860.10 -এ ক্লোজ হওয়ার পর 2:15 তে 1860.80 লেভেলে দ্বিতীয় ক্যান্ডেলস্টিক তৈরি হওয়া শুরু হয়। এটার রঙ লাল কারণ ক্লোজ হয় ওপেনিং প্রাইসের নিচে 1850.10 টাকায়।
এর আরো একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিচে কোনো উইক নেই। কারণ এক্ষেত্রে ক্লোজিং প্রাইস এবং সর্বনিম্ন দাম বা লোয়েস্ট প্রাইস একই।
তৃতীয় ক্যান্ডেলস্টিকে আবার কোনরকম বডিরই অস্তিত্ব নেই। কারণ হচ্ছে এক্ষেত্রে ওপেনিং এবং ক্লোজিং প্রাইস একই।
ছবিটার বাকি বিবরণী মনে হয় আর দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না কারণ আশা করি সেটা এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
ক্যান্ডেলস্টিকের ধরণ ও ব্যবহার প্রণালী
উপরের উদাহরণে ক্যান্ডেলস্টিকের কয়েকটা ধরণ আপনি ইতিমধ্যেই দেখতে পেয়েছেন। ওগুলো ছাড়াও দামের ওঠানামার উপর ভিত্তি করে এগুলোর প্রত্যেকটা বিশেষ বিশেষ আকারের হয় আর এগুলোর ধরন অনুযায়ী সে সময়ে বাজারে উপস্থিত বায়ার এবং সেলারদের তুলনামূলক প্রাধান্যের কথা বোঝা যায়।
এবং পরপর একসাথে অনেকগুলো ক্যান্ডেলস্টিকের প্যাটার্নের উপর নির্ভর করে আগামীতে কি হতে পারে তার একটা সম্ভাব্য ধারণা করে নেওয়া যায়।
এ বিষয়ে বিশদে অন্য কোনো আর্টিকেলে আলোচনা করা যাবে।
সীমাবদ্ধতা
- লাইভ চার্ট না দেখলে একটা ক্যান্ডেলস্টিকের মধ্যে দামের ওঠানামা ঐ টাইম ফ্রেমের মধ্যে কখন কিভাবে হয়েছিল সেটা কিন্তু বোঝা যায় না বা সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন দামের মধ্যে কোনটায় আগে এবং কোনটায় পরে পৌঁছেছিল সেটাও বোঝা যায় না।
- বিভিন্ন টাইম ফ্রেমের চার্ট থেকে অনেক সময় আলাদা আলাদা মানে বেরিয়ে আসতে পারে।
শেষ কথাঃ
শেয়ার বাজার একটা সমুদ্রের মতো। এখানে শেখার কোনও শেষ নেই। ক্যান্ডেল স্টিক চার্ট পড়ার কায়দা শিখে নেওয়া মানেই কিন্তু সবকিছু শেখা হয়ে গেলো না। তাছাড়া অন্য সব চার্টের মতো এই চার্ট থেকেও একটা সম্ভাবনার আঁচ পাওয়া যায় মাত্র। সেই সম্ভাবনা বাস্তব হবে কি হবেনা তার কোনও গ্যারান্টি কিন্তু পাওয়া যায় না।
আর এর কার্যক্ষমতা বা সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা, ট্রেডিং স্টাইল ইত্যাদি হরেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে।
সুতরাং আরও পড়ুন, জানুন আর চার্টের দিকে তাকিয়ে দিনের পর দিন বসে থাকুন ও বোঝার চেষ্টা করুন। তাহলেই দেখবেন আপনিও ভুত এবং বর্তমানের উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছেন…
সম্পর্কিত পাঠঃ সেরা 20 ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন। চার্ট পড়তে হলে জানা চাই-ই-চাই! সবথেকে সেরা 10+ চার্ট প্যাটার্ন। এগুলো না জেনে শেয়ার ট্রেডিং সম্ভব নয়।