শেয়ার বাজার মানে অনেকের কাছেই জুয়া খেলার জায়গা। আর যারা এই বাজারকে এমন নজরে দেখেন না, তাদের মধ্যে আবার সাধারণ ধারণা হচ্ছে এখানে কাজ মানে হয় ট্রেডিং কিংবা ইনভেস্টিং। কিন্তু বাস্তবে এখানে ট্রেডিং, ইনভেস্টিং বা জুয়া খেলা ছাড়াও আয়ের বা কেরিয়ার তৈরি করার অন্য অনেক রাস্তাও আছে।
বর্তমানে বিশালতার বিচারে ভারতীয় শেয়ার বাজারের স্থান বিশ্বে পঞ্চম। করোনা আসার পর থেকে এখানে অংশগ্রহণকারীদের এক বিশাল সুনামির আগমন হয়েছে। এখানে ট্রেড বা ইনভেস্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় ডিম্যাট কাম ট্রেডিং একাউন্টের সংখ্যা বিগত কয়েক বছরে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। শেয়ার বাজার কমার্সের একটা বিষয় হলেও এটা ছাড়াও সায়েন্স, আর্টস, হিউম্যানিটিস ইত্যাদি অন্যান্য শাখা থেকেও অনেকেই এখানে কেরিয়ার তৈরি করার দিকে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
পৃথিবীর বড় বড় দেশ গুলোতে শেয়ার বাজার এবং এই বাজার সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তাদের ইকোনমির একটা বিশাল অংশ অধিকার করে আছে। ভারত যেহেতু উন্নয়নশীল দেশ এবং এখানে শেয়ার বাজারের জনপ্রিয়তা সবে বাড়তে আরম্ভ করেছে, তাই বিশেষজ্ঞদের মত ২০২৬ সালের মধ্যে এদেশে অন্যান্য ক্ষেত্রের গড় কর্মসংস্থানের থেকে শেয়ার বাজারের পেশাদারদের জন্য কর্মসংস্থান দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাবে।
শেয়ার বাজার আর্থিক ক্ষেত্রের আকর্ষণীয় কিছু কাজের প্ল্যাটফর্ম প্রোভাইড করে। চলনসই দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা থাকলে, এই ক্ষেত্রের পেশাদারদের ভালো আয়ের সুযোগ আছে।
তাহলে চলুন দেখে নেওয়া যাক, সরাসরি শেয়ার কেনাবেচা বা ট্রেড-ইনভেস্টের সাথে জড়িত না হয়েও এখানে আয়ের বা কেরিয়ার তৈরি করার কী কী বিকল্প উপায় হতে পারে…
স্টক ব্রোকার
ট্রেডিং ও ইনভেস্টিং শেয়ার বাজার থেকে আয়ের (বা ক্ষতির!) প্রধান উৎস হলেও এগুলো করতে যারা ইচ্ছুক তাদের দরকার পড়ে ডিম্যাট কাম ট্রেডিং অ্যাকাউন্টের। এই বাজারের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিভিন্ন ব্রোকাররা এই ডিম্যাট কাম ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট প্রোভাইড করে।
শেয়ার কেনাবেচা করে ট্রেডার বা ইনভেস্টারদের লাভ হোক বা ক্ষতি, ব্রোকাররা কিন্তু সবসময়ই ব্রোকারেজ কমিশন পায়। তাই যেকোনো একটা শেয়ার কেনাবেচার ক্ষেত্রে জড়িত তিন পক্ষ যথা ক্রেতা, বিক্রেতা ও ব্রোকারের মধ্যে সব সময়ে লাভ হয় কেবলমাত্র ব্রোকার-এরই।
তাই অনেকের কাছে ট্রেডার বা ইনভেস্টার হওয়ার থেকে ব্রোকার হওয়া বেশি আকর্ষণীয়। আর যেহেতু শেয়ার বাজারে নতুন নতুন অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা নিত্যদিন বাড়ছে তাই এই ব্রোকিং-এর বাজারও ক্রমাগত বাড়ছে।
ভারতের সবথেকে বড় ব্রোকার জিরোধার প্রতিষ্ঠাতা নীতিন কামাথ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে নিজের কেরিয়ার শুরু করলেও শেয়ার বাজার তাকে এতটাই রোমাঞ্চিত করে যে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর রাস্তা ছেড়ে দিয়ে ২০১০ সালে ভারতের প্রথম ডিসকাউন্ট ব্রোকার জিরোধা শুরু করেন। ১২ বছর পরে 60 লাখেরও বেশি কাস্টমার নিয়ে আজ জিরোধা ভারতের এক নম্বর ব্রোকারে পরিণত হয়েছে এবং লাভের অঙ্কে ২০০০ কোটি কেও ছাপিয়ে গেছে।
সুতরাং ব্রোকিং ব্যবসায় সম্ভাবনা কতটা সেটা আশা করি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্টক ব্রোকার হওয়ার জন্য বা স্টক ব্রোকিং কোম্পানি খোলার জন্য কোনো বাঁধাধরা যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে না। এনআইএসএম পরীক্ষায় পাশ করলেই সেবির থেকে ব্রোকিং লাইসেন্স পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে কেরিয়ার তৈরির জন্য বাজার সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান থাকাটা ভীষণভাবে জরুরী।
আবার চাইলে শুরুতে অন্য ব্রোকারের অধীনে সাব ব্রোকারশিপ নিয়েও কাজ করা যায়। দুই ক্ষেত্রে কাজ টা একই। মানে ক্লায়েন্ট খোঁজা এবং অ্যাকাউন্ট তৈরি করার জন্য রাজি করানো। নিজস্ব ব্রোকার ব্যবসা শুরু করার আগে এভাবে কাজ শুরু করলে নিজে ব্রোকার হওয়ার ঝামেলাটা এড়িয়ে এই কাজের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাটা হয়ে যায়।
আবার বিকল্প হিসেবে অন্য ব্রোকারের কোম্পানিতে চাকরিও খোঁজা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কোম্পানির প্রয়োজনীয়তা এবং নিজের যোগ্যতা বা দক্ষতা অনুযায়ী এই ব্যবসা সংক্রান্ত বিবিধ কাজের মধ্যে যেকোনো একটা কাজ করা যেতে পারে। এটাও কিন্তু ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা তৈরি করার ভালো একটা উপায়। শুরুর কয়েক বছর এভাবে চাকরি করার পরে নিজস্ব ব্রোকিং ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়।
ফিনান্সিয়াল বা ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজার
শেয়ার বাজার সমুদ্রের মতো। এখানে কোথায়, কিভাবে, কতটা বিনিয়োগ করা উচিৎ সেটা বেশীরভাগ নতুন বিনিয়োগকারীই ভালো ভাবে বোঝে না। তাই তাদের সঠিক পথ দেখানোর জন্য দরকার পরে ফিনান্সিয়াল বা ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজার দের।
কিন্তু যে কেউ চাইলেই নিজের খুশি মত ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইজার হতে পারে না। লাইসেন্স ছাড়া ডাক্তারি করা যেমন বেআইনি, একইভাবে উপযুক্ত লাইসেন্স ছাড়া শেয়ার বাজারের যেকোনো ধরনের ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইস দেওয়াও কিন্তু বেআইনি।
তাই লাইসেন্স প্রাপ্ত ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইজার হয়ে নিজস্ব কনসাল্টিং বিজনেস শুরু করা এই বাজারে কেরিয়ার তৈরির একটা ভালো বিকল্প। ভারতের মতো জনবহুল দেশে যারা এখনো শেয়ার বাজারের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত হননি বা যুক্ত হতে ইচ্ছুক সেই সংখ্যাটা মোটেও কম না। তাদেরকে একজন ফিনান্সিয়াল অ্ডযাভাইজার হিসেবে বিনিয়োগের খুঁটিনাটি শিখিয়ে পড়িয়ে রাজি করাতে পারলেই আপনার ব্যবসার জন্য ক্লায়েন্টের কোনো কমতি হবে না।
ফাইন্যান্স বা কমার্স শাখায় যেকোনো একটা গ্রাজুয়েট ডিগ্রি আর এই ক্ষেত্রের কোনো কোম্পানিতে পাঁচ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেই লাইসেন্সের জন্য অ্যাপ্লাই করা যায়। তবে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি থাকলে কর্মক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পড়ে না। এছাড়াও আরো কিছু কিছু এলিজিবিলিটি ক্রাইটেরিয়া থাকে যেগুলো পূরণ করার পর এনআইএসএম ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজারি সার্টিফিকেশন পরীক্ষায় পাস করলেই সেবির তরফ থেকে ইনভেসমেন্ট অ্যাডভাইজার হওয়ার লাইসেন্স পাওয়া যায়।
রিসার্চ অ্যানালিস্ট
রিসার্চ এ্যানালিস্টের কাজ হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের আর্থিক তথ্য সংগ্রহ ও সংগঠিত করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা। ইনভেসমেন্ট এডভাইজার হওয়ার মতো রিসার্চ এ্যানালিস্ট হওয়াও কেরিয়ার তৈরীর একটা ভালো উপায় হতে পারে।
এই অ্যানালিস্টরা দু ধরনের হন যথা, বাই-সাইড অ্যানালিস্ট আর সেল-সাইড অ্যানালিস্ট। বাই-সাইড অ্যানালিস্টরা বিভিন্ন আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান, যারা সাধারণ মানুষের টাকা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে, তাদের হয়ে কাজ করে। এই সমস্ত অ্যানালিস্টরা বিবিধ শেয়ারের বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানের ফান্ড ম্যানেজারদের ফান্ডের বর্তমান পোর্টফোলিওর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
আর সেল-সাইড অ্যানালিস্টরা রিটেল ট্রেডার ও ইনভেস্টারদের প্রয়োজন অনুযায়ী শেয়ার বাজারের বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্টের অ্যানালিসিস করে থাকেন।
নিজে স্বতন্ত্র রিসার্চ এ্যানালিস্ট হয়ে কাজ করতে চাইলে এলিজিবিলিটি ক্রাইটেরিয়া ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজার হওয়ার মতোই। তবে অন্য কোম্পানির হয়ে এই কাজ করতে চাইলে সাধারণত বড় বড় কোম্পানিগুলোর চাহিদা অনুযায়ী এমবিএ গ্রাজুয়েট বা সিএফএ ও সিএ-রা এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়।
পোর্টফোলিও ম্যানেজার
শেয়ার বাজার সংক্রান্ত মিউচুয়াল ফান্ডে কখনো বিনিয়োগ করে থাকুন বা না থাকুন এই ব্যাপারে শুনে নিশ্চয়ই থাকবেন। মিউচুয়াল ফান্ড গুলো আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষের টাকা একত্রিত করে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে থাকে। আর ওই বিশাল পরিমাণ টাকার পরিচালনা করে যোগ্য ও বিশেষজ্ঞ পোর্টফোলিও বা ফান্ড ম্যানেজাররা।
টাকা পয়সা ম্যানেজ করা আপনার পছন্দের বিষয় বা দক্ষতার ক্ষেত্রে হলে পোর্টফোলিও ম্যানেজার হওয়া দারুন একটা কেরিয়ার অপশন হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সিএ, সিএফএ বা এমবিএ এবং সাথে আর্থিক ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা অত্যাবশ্যক। ফ্রেশার হিসেবে এই ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ পাওয়া মোটেও সহজ নয় কারণ কোটি কোটি টাকা হ্যান্ডেল করার মত ম্যাচুরিটি নতুনদের থাকেনা।
শেষ কথা
উপরে দেওয়া শেয়ার বাজারের এই সমস্ত বিকল্প কেরিয়ারের দিকে যেতে চাইলে শেয়ার বাজার ও এর আনাচে কানাচে কি ঘটে চলে সেসব ব্যাপারে গভীর জ্ঞান এবং ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা থাকাটা জরুরী। এর পাশাপাশি ভালো কমিউনিকেশন এবং বিশ্লেষণ করার দক্ষতা থাকলে এ ধরনের কাজের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া যায়।