আজকের দিনে যেকোনো একটা ব্যাংকে একটা সেভিংস অ্যাকাউন্ট বা বিভিন্ন ব্যাংকে একাধিক সেভিংস অ্যাকাউন্ট আমাদের অনেকেরই আছে। ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল ট্রানজেকশন করতে হলে সেভিংস অ্যাকাউন্ট তো লাগবেই। কিন্তু এই সেভিংস অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো পদে পদে কত রকম বাহানায় কতশত চার্জ যে কেটে নেয় আমাদের অজান্তে সে ব্যাপারে না জানলে কিন্তু ব্যাংকগুলো চার্জের বাঁশ দিতে দিতে আপনার অ্যাকাউন্ট টাকে বাঁশ বাগান বানিয়ে দেবে। আর এইসব চার্জের ব্যাপারে ব্যাংকের লোক কিন্তু কখনো আপনাকে আগে থেকে বলবে না। তাই আজ এইসব হরেক রকম ব্যাংক চার্জের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হলে লেগে থাকুন এই আর্টিকেলের শেষ পর্যন্ত।
কি কি কারনে বা কি কি পরিস্থিতিতে কত শত চার্জ কাটা হয় তাই আমি এখানে শেয়ার করছি…
অ্যাকাউন্ট ওপেনিং-এর সময়
না বাঁশ বাগানে ঢোকার জন্য কোন চার্জ দিতে হয় না! কি শান্তি তাই না? কিন্তু শান্তিটা ওই গেটে ঢোকার মুখেই শেষ। একাউন্ট ওপেনিং এর পরই প্রতিটা পদে চার্জের বাঁশ খাওয়ার জন্য রেডি থাকুন।
চেক বুক ইস্যুর সময়
সাধারণত ব্যাংক ভেদে বছরে 10 টা থেকে 25 টা চেকসহ একটা চেক বুক ফ্রিতে পাওয়া যায়। এর বাইরে চেকবুকের দরকার পড়লে ব্যাংক ভেদে 50 থেকে 100 টাকা বা তারও বেশি চার্জ কেটে নেয়।
অ্যাভারেজ মান্থলি ব্যালেন্স না মেনটেন করলে
বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন ধরনের সেভিংস অ্যাকাউন্টে এই চার্জ টা বিভিন্ন। আপনার অ্যাকাউন্টের অ্যাভারেজ মান্থলি ব্যালেন্স আপনার অ্যাকাউন্টের জন্য নির্ধারিত এমাউন্টের নিচে যদি নেমে যায় তাহলে 150-200 থেকে শুরু করে 600-700 টাকা পর্যন্ত কেটে নিতে পারে।
ডুপ্লিকেট পাস বই-এর প্রয়োজন পড়লে
প্রথম পাস বই এবং সেই পাস বই শেষ হয়ে গেলে কন্টিনিউয়েশন-এ তার পরের যে পাস বই লাগে সেটা ওরা ফ্রিতেই দেয়। কিন্তু যদি পাস বই হারিয়ে ফেলেন এবং ডুপ্লিকেট পাস বই দরকার পড়ে তাহলে কিন্তু কেস। ডুপ্লিকেট পাস বইয়ের জন্য এপ্লাই করলেই 100 টাকা ঘ্যাচাং ফু।
ডেবিট কাম এটিএম কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে
আজকের ডিজিটাল ব্যাংকিং এর যুগে অনলাইনে পেমেন্ট করতে হোক, এটিএম থেকে টাকা তুলতে হোক বা ইউপিআই অ্যাক্টিভেট করতে হোক, ব্যাংকের ডেবিট কাম এটিএম কার্ড অতি প্রয়োজনীয় একটা জিনিস। কিন্তু এই কার্ড সম্পর্কিত চার্জের বহর-ও কম নয়।
- সেভিংস ব্যাংক একাউন্ট ওপেন করার সময় বা ডেবিট কার্ডের এপ্লাই করলে ডেবিট কার্ড ইস্যু করার সময় কিছু কিছু ব্যাংকের কিছু কিছু কার্ডে কোনও চার্জ দিতে হয় না। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেসিক থেকে প্রিমিয়াম কার্ডের জন্য 100 থেকে 750 টাকা পর্যন্ত দিতে হতে পারে।
- ডেবিট কার্ড ডিসপ্যাচ হওয়ার পর যদি কোনো কারণে কুরিয়ার সেটা আপনার বাড়িতে পৌঁছে দিতে না পারে এবং সেটা ফিরে যায় তাহলে কিন্তু 100 টাকা পেনাল্টি।
- যে কার্ড এর যত ইসুয়ান্স ফি সেটাই সেই কার্ডের মেনটেনেন্স ফী যেটা প্রতিবছরের প্রথমে দিতে হয় দ্বিতীয় বছর থেকে। ইসুয়ান্স ফি অনেক সময় না নেওয়া হলেও খুব কম কিছু পরিস্থিতিতে কিছু কার্ড বাদ দিয়ে বেশির ভাগ ডেবিট কার্ডেই অ্যানুয়াল মেনটেনেন্স ফী দিতে হয়।
- ডেবিট কার্ড কোনো কারণে রিপ্লেস করতে হলে 200-300 টাকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
- যদি ডেবিট কার্ডের পিন ভুলে যান এবং ব্রাঞ্চ-এর মাধ্যমে ডুপ্লিকেট পিন জেনারেশন করতে হয় তাহলে তার জন্য আপনাকে 50 টাকা চার্জও দিতে হবে।
- কোন কারনে এটিএম ট্রানজেকশন ডিক্লাইন হলে ফাইন 20-25 টাকা।
- ইন্টারন্যাশনাল ট্রানজেকশন এর জন্য ট্রানজাকশন অ্যামাউন্টের থেকে 3-3.5% বেশি দিতে হয় ট্রানজাকশন চার্জ হিসাবে। এমনকি বিদেশের কোন এটিএমে ব্যালেন্স চেক করতে হলেও 25 টাকা খরচ হয়।
চেক কালেকশনের সময়…
আজকাল ডিজিটাল পেমেন্ট এর যুগে পার্সোনাল ক্ষেত্রে চেক-এর ব্যবহার যদিও অনেকটা কমে গেছে, তবুও যখনই চেক ব্যবহার করতে যাবেন তখনই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আপনাকে নিম্নলিখিত চার্জ গুলো দিতে হতে পারে।
- স্পিড ক্লিয়ারিং সিস্টেম ব্যবহার করলে 200 টাকা।
- আউটস্টেশন চেকের জন্য অ্যামাউন্টের ওপর ভিত্তি করে 50 থেকে 200 টাকা।
- অন্যজনের দেওয়া চেক বাউন্স হলে এমাউন্টের উপর ভিত্তি করে 150 থেকে 250 টাকা।
- ইনসাফিশিয়েন্ট বা অপর্যাপ্ত ব্যালেন্সের জন্য চেক বাউন্স হলে 500 টাকা।
- পেমেন্ট ইন্সট্রাকশন বন্ধ করতে হলে 100 থেকে 200 টাকা।
NACH করতে হলে
লোন, ইনস্যুরেন্স বা অন্যান্য পেমেন্টের ক্ষেত্রে যদি আপনি অটোমেটেড পেমেন্ট এর ব্যবস্থা করতে চান তাহলে ন্যাশনাল অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস বা NACH ম্যান্ডেট করতে হয়। এই এনএসিএইচ ম্যান্ডেট অথোরাইজেশন এর জন্য 50 আর ফেল হলে হলে 250 টাকা চার্জ দিতে হয়।
ডিমান্ড ড্রাফট প্রয়োজন পড়লে
ডিমান্ড ড্রাফ্ট ইস্যু করার জন্য অ্যামাউন্ট এর ওপর নির্ভর করে 25 থেকে 2000 টাকা পর্যন্ত কাটে এবং ডিমান্ড ড্রাফট ক্যানসেলেশনের জন্য 25 থেকে 100 টাকা পর্যন্ত কাটে।
ক্যাশ ট্রানজেকশনের সময়
সরকার এবং ব্যাংকের তরফে একদিকে যেমন ডিজিটাল ট্রানজেকশন প্রমোট করা হচ্ছে তেমনি অন্যদিকে চাওয়া হচ্ছে যেন ক্যাশ ট্রানজেকশন যতটা সম্ভব ততটা কম হয়। আর সেজন্যই ক্যাশ ট্রানজেকশন কম করার অছিলায় এর উপরে নতুন নতুন চার্জ বসানো হচ্ছে।
- ব্যাংকে যদি আপনি ক্যাশ ডিপোজিট করতে চান প্রতি মাসে তিনটে ফ্রি ডিপোজিট এর উপরে যতবার ডিপোজিট করতে চাইবেন 50 টাকা করে এক্সট্রা খরচ হবে।
- ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন এর মাধ্যমে থার্ড পার্টি একাউন্টে ক্যাশ ডিপোজিট করতে হলে বা কার্ডলেস ট্রানজেকশন করতে হলে 22 টাকা এক্সট্রা দিতে হবে।
- ব্রাঞ্চ থেকে ক্যাশ উইথড্র করতে হলে নির্দিষ্ট লিমিটের ওপরে যতবার ক্যাশ ইউজ করতে চাইবেন 50 টাকা এক্সট্রা লাগবে। এক্ষেত্রে আপনার অ্যাভারেজ মান্থলি ব্যালেন্স যত বেশি হবে নির্দিষ্ট লিমিট টাও তত বেশি হবে।
- এটিএম থেকে টাকা তোলার লিমিটও সাধারণত মাসে 3 থেকে 5 বার থাকে। লিমিটের বাইরে টাকা তোলার জন্য 10 থেকে 20 টাকা এক্সট্রা খরচ হয়।
- ইনসাফিশিয়েন্ট ফান্ডের জন্য কখনো ট্রানজেকশন ডিক্লাইন্ড হলে 20 থেকে 25 টাকা চার্জ কেটে নেওয়া হয়।
এনইএফটি এবং আরটিজিএস ট্রান্সফার-এর সময়
এনইএফটি বা আরটিজিএস এর মাধ্যমে আপনি যদি টাকা ট্রান্সফার করতে চান তাহলে অ্যামাউন্টের উপর নির্ভর করে 2 থেকে 40 টাকা পর্যন্ত কেটে নিতে পারে।
ইউপিআই বা আইএমপিএস এর মাধ্যমে টাকা ট্রান্সফারের সময়ে
ইউপিআই ভারতের যুগান্তকারী এক উদ্ভাবন। ভারতের ডিজিটাল ট্রানজেকশন এত এত বাড়ার প্রধান কারণ এটাই। তাই আপাতত এই ইউপিআই-তে কোনও ফী নেওয়া হয়না। আর আইএমপিএস ও খানিকটা একই রকম এবং এক্ষেত্রেও নিজে টাকা পাঠানো হলে কোনও চার্জ কাটে না তবে ব্রাঞ্চের মাধ্যমে যদি আইএমপিএস করতে হয় সেক্ষেত্রেও কুড়ি টাকা পর্যন্ত এক্সট্রা কাটে।
ফোন ব্যাংকিং করার সময়
ফোন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে একাউন্ট স্টেটমেন্ট, ইন্টারেস্ট সার্টিফিকেট ইত্যাদি ডকুমেন্টের ফিজিক্যাল ডেলিভারি নিতে গেলেই কিন্তু 50 টাকা পর্যন্ত কেটে নিতে পারে।
ডোর স্টেপ ব্যাংকিং-এর সুবিধা নিতে চাইলে
অনেক ব্যাংকে কাস্টমারের জন্য ডোর স্টেপ ব্যাংকিং এর সুবিধা আছে। আপনার ব্যাংকেও যদি এরকম সুবিধা থাকে তাহলে সেই সুবিধা নেওয়ার আগে জেনে নিন তার জন্য কত চার্জ কাটবে। কোনো কোনো ব্যাংকে ডোর স্টেপ ব্যাংকিং এর জন্য 60 থেকে 100 টাকা কেটে নেয় কিন্তু।
এসএমএস এলার্ট পাঠাবার জন্য
বিভিন্ন ট্রানজেকশনের জন্য যে সমস্ত এসএমএস অ্যালার্ট আসে সেটাও ফ্রী না! ব্যাংক ভেদে ও ট্রানজেকশনের ফ্রিকোয়েন্সির উপর নির্ভর করে বছরে এই অজুহাতে 50 টাকা পর্যন্ত কেটে নিতে পারে।
এছাড়াও বিবিধ কারণে
- ব্যালেন্স সার্টিফিকেট পেতে চাইলে 150 টাকা।
- ডুপ্লিকেট ইন্টারেস্ট সার্টিফিকেটের জন্য 150 টাকা।
- নো ডিউস সার্টিফিকেটের জন্য 100 টাকা।
- সিগনেচার ভেরিফিকেশনের জন্য 150 টাকা।
- ফটো এটেস্টেশনের জন্য 150 টাকা।
- চেকের রেকর্ড কপি পেতে চাইলে 150 টাকা।
- পাওয়ার অফ অ্যাটর্নির মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট অপারেট করতে চাইলে 500 টাকা।
অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার সময়
এমনকি আপনি যদি অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে চান তখনও ছাড় নেই। এক্ষেত্রেও 500 টাকা পর্যন্ত কেটে নিতে পারে।
চার্জের উপরে ট্যাক্স বা জিএসটি
শুধুমাত্র যে ব্যাংকগুলোই এসব চার্জ থেকে লাভ করে তা নয়, এই লাভ সরকারের কাছেও যায়। গোদের উপরে বিষ ফোঁড়ার মতো এই সমস্ত চার্জের উপরে কিন্তু আমাদের আবার ট্যাক্স বা জিএসটি-ও দিতে হয় যেটা সরকারের ঝুলিতে যায়। প্রত্যেকটা চার্জের উপরে জিএসটি হিসাবে অতিরিক্ত 18% এক্সট্রা কেটে নেওয়া হয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
উপরে যে যে চার্জের কথা বলেছি সেগুলো বাদ দিয়েও আরো কিছু ক্ষেত্রে চার্জ কাটে তবে সেগুলো যে সমস্ত বিষয়ে প্রযোজ্য সেগুলো সচরাচর সাধারণ মানুষের প্রয়োজন পড়ে না তাই আর উল্লেখ করলাম না। আর এই চার্জগুলোর ক্ষেত্রে বড় বড় কয়েকটা ব্যাংকের নিয়ম ফলো করেছি, তবে আরও অন্যান্য ব্যাংকের ক্ষেত্রে বা বিশেষ ধরণের কোনও অ্যাকাউন্ট এর ক্ষেত্রে এই চার্জ গুলোর কিছু কিছু তড়িৎপাত হতে পারে।
শেষ করার আগে…
ব্যাংকের সেভিংস একাউন্টে এখন নরমালি ইন্টারেস্ট দেয় 2.7%। আর সেই সেভিংস একাউন্টেই চার্জের বহর তো দেখলেন। আপনার নিজের অ্যাকাউন্টের চার্জ গুলোর ব্যাপারে জানুন এবং এলার্ট থাকুন। নয়তো ওই সেভিংসের ইন্টারেস্ট হিসাবে ব্যাংক আপনাকে যা দেবে আবার চার্জের মাধ্যমে সেটা নিয়েও নেবে। আর এবারে একটু ভাবুন আপনি কি করবেন আরো আরো বেশি ক্যাশ ব্যাংকে ফেলে রাখবেন নাকি এবার শেয়ার বাজারে জমানোর কথা ভাববেন? শেয়ার বাজারে জমাতে চাইলে অনেক রকম গাইড এই ওয়েবসাইটে পেয়ে যাবেন। তাহলে আজকের মত এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, টাকা বাঁচিয়ে রাখুন, টাকা বাড়াতে থাকুন। টা টা 🙂