বড় দামী কিছু কেনাকাটার বোঝা কমানোয় এবং ক্রেতাকে কেনাকাটা-টা ঝটপট সেরে ফেলার জন্য প্ররোচিত করতে নো কস্ট ইএমআই (No Cost EMI) এর জুড়ি মেলা ভার! কিন্তু কেনাকাটা করা সহজ বা সহজলভ্য করে দিলেও, আদপে এই সুবিধা নিয়ে আমাদের মত ক্রেতাদের সত্যিই কি কোন লাভ বা সুবিধা হচ্ছে? নাকি যা সুবিধা সবই দোকান বা শপিং ওয়েবসাইট কিংবা ব্র্যান্ড বা ব্যাংকের? নো কস্ট ইএমআই No Cost নাকি এই সুবিধা নেওয়া মানে শুধুই আমাদের কষ্ট? চলুন এই আর্টিকেলে জেনে নিই নো কস্ট ইএমআই-তে শখের দামী জিনিস কেনাটা আসলে আমাদের জন্য Easy হচ্ছে নাকি Costly?
ইএমআই (EMI) কী?
আমরা আয় করি শেষ পর্যন্ত সেটা খরচ করতেই তাই না? আর খরচ করতে চাই আমাদের শখ গুলো, ইচ্ছে গুলো পূরণ করতে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে বেশির ভাগ সময়েই শখগুলো আমাদের আয়ত্তের বাইরে থাকে। আর মাসের পর মাস টাকা জমিয়ে সেটা আয়ত্তের মধ্যে আনা মানে লম্বা অপেক্ষা করা। কিন্তু পছন্দের জিনিসটা ব্যবহার করতে আমাদের মনের কি আর অপেক্ষা সয়? আর আমাদের মনের ওই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্র্যান্ড, দোকান বা আজকের শপিং ওয়েবসাইটগুলো ইএমআই এর সুবিধা দেয় যার সাহায্যে কেনার সময় বিশেষ কোনো খরচ না করেই পছন্দের দামী জিনিসটা তৎক্ষণাৎ হাতে পাওয়া যায়।
কিন্তু এই অধরা আনন্দ সময়ের আগেই ধরতে পারার জন্য কিছু Cost তো পে করতেই হবে তাই না? ইএমআই এর ফুল ফর্ম Equated Monthly Installment । এর এর সুবিধা নেওয়া মানে আসলে লোন নেওয়া। আর সেই লোনের টাকা সুদসহ মান্থলি ইনস্টলমেন্টে শোধ করার নামই হচ্ছে ইএমআই। এধরনের কনজিউমার ইএমআই তে ইন্টারেস্ট রেটও খুব একটা কম হয় না। এক্ষেত্রে সাধারনত কমবেশি 15% ইন্টারেস্ট দিতে হয়। যেখানে ফিক্স ডিপোজিটের ইন্টারেস্ট রেট 7% সেখানে বুঝতেই পারছেন এই 15% ইন্টারেস্ট রেট-টা বেশ হাই।
নো কস্ট ইএমআই (No Cost EMI) কী?
এই ইন্টারেস্ট রেট এর কষ্ট দূর করতে বা ইন্টারেস্ট দেওয়ার ভয়ে যাতে ক্রেতারা আবার কেনাকাটা করতে পিছপা না হন তার জন্য যে নতুন জিনিস উদ্ভাবন করা হয়েছে সেটা হচ্ছে নো কস্ট ইএমআই। নো কস্ট ইএমআই মানে যা বোঝায় তাই, এটাও এক ধরনের ইএমআই কিন্তু এক্সট্রা কোন কস্ট ছাড়া। সাধারণ ইএমআই তে যে 15% ইন্টারেস্ট দিতে হয় এক্ষেত্রে সেটা দিতে হয় না। তবে কেবলমাত্র ইন্টারেস্টটুকুকেই বোঝানো হচ্ছে। ইন্টারেস্টটুকু বাদ দিয়েও আরো কিছু খরচ থাকে সেগুলো কিন্তু ধরতব্যের মধ্যে রাখা হচ্ছে না।
কখন কোথায় কোন জিনিসে পাওয়া যায়?
সব সময় সব জিনিসে নো কস্ট ইএমআই এর সুবিধা পাওয়া যায় না। ই-কমার্স ওয়েবসাইটগুলোতে যে প্রোডাক্টে নো কস্ট ইএমআই অ্যাভেলেবল আছে তার নিচে সেটা দেখানো থাকে। আর অফলাইনে দোকানে এনকয়ারি করে দেখতে হয় আপনার পছন্দের জিনিসে এটা অ্যাভেলেবল আছে কিনা। সাধারণত মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স আইটেম, বড় অ্যাপ্লায়েন্স ইত্যাদি বিভিন্ন রকম দামি দামি কনজিউমার আইটেমে এর সুবিধা পাওয়া যায়। অনলাইনে বিভিন্ন সেলগুলোর সময় বেশি বেশি প্রোডাক্ট-এর ওপর এই সুবিধা নেওয়া যায় ।
নো কস্ট ইএমআই এর সুবিধা নিতে কী দরকার হয়?
এই সুবিধা নিতে হলে কোনো একটা ইএমআই নেটওয়ার্ক কার্ড যেমন বাজাজ ইএমআই কার্ড বা কোনো একটা ক্রেডিট কার্ড থাকলেই চলে। তবে সময় বিশেষে বিভিন্নরকম আলাদা আলাদা কার্ডে আলাদা আলাদা প্রোডাক্ট এর উপর এই সুবিধা পাওয়া যায়।
ভারতের সবথেকে বড় ই-কমার্স ওয়েবসাইট অ্যামাজন এবং ফ্লিপকার্ট-এর ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ক্রেডিট কার্ড যথাক্রমে অ্যামাজন পে আইসিআইসিআই ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড এবং ফ্লিপকার্ট এক্সিস ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডে এই সুবিধা বেশি প্রোডাক্ট-এর উপর বছরের বেশি সময়ে পাওয়া যায়।
পুরো বিষয়টা কিভাবে কাজ করে?
সাধারণ ইএমআই এর সুবিধা নিয়ে কেনাকাটা করলে প্রথমত যেটা হয় কার্ড থেকে পুরো এমাউন্টটাই ব্লক করা হয় বা কেটে নেওয়া হয়। তারপর আগামী কিছুদিনের মধ্যে ওটা ইএমআই তে কনভার্ট হয়ে যায়। মানে পুরো অ্যামাউন্ট সে মাসে বিল হয় না, যত মাসের ইএমআই প্ল্যান সিলেক্ট করা হয়েছিল কেনার সময়, ইন্টারেস্ট যোগ করে তত গুলো সমান ইনস্টলমেন্টে ভাগ করে আগামী প্রতিমাসের বিলে অ্যাড হয়ে যায়।
নো কস্ট ইএমআই তেও একই ভাবে কার্ড প্রোভাইডার কিন্তু ইন্টারেস্ট পায়। তবে সেটা ক্রেতাকে দিতে হয়না। সেটা বহন করে ব্রান্ড বা ই-কমার্স ওয়েবসাইটগুলো। আর তাই জিনিস কেনার সময় মোট জিনিসের দাম থেকে মোট ইন্টারেস্ট যেটা হাওয়ার কথা সেটা বাদ দিয়ে পেমেন্ট করতে হয় বা কার্ড থেকে কাটা হয়। এরপর সাধারণ ইএমআই এর মত ইএমআই তে যখন কনভার্ট হয় তখন ইন্টারেস্ট যোগ হয়ে এমন অ্যামাউন্ট আসে যেটা জিনিসের পুরো দাম কে ইএমআই এর সময়কাল দিয়ে ভাগ করলে যা হয় তাই।
সরাসরি কী কী এক্সট্রা খরচ হয়?
এক্ষেত্রে ইনস্টলমেন্ট = জিনিসের দাম / মাস। মানে যদিও মনে হচ্ছে কোনো এক্সট্রা খরচ লাগছে না, কিন্তু আসলে তা নয়। জিনিস কেনার সময়-ই প্রসেসিং চার্জ হিসেবে সাধারণত 200 টাকা প্লাস ট্যাক্স পে করতে হয় যেটা প্রথম মাসের ইএমআই এর সঙ্গে দিতে হয়। এছাড়াও যে ইন্টারেস্টটা ছেড়ে দেওয়া হয় বা তার উপর 18% জিএসটি টা কিন্তু ছেড়ে দেওয়া হয় না। মানে, ইন্টারেস্ট দিতে না হলেও ইন্টারেস্ট অ্যামাউন্ট এর উপরে 18% জিএসটি হিসাব করলে যে অ্যামাউন্ট আসে সেটা প্রতি মাসে ইএমআই এর সঙ্গে এক্সট্রা হিসেবে দিতে হয়।
কিছু ছাড় হাতছাড়া হতে পারে!
পুরো পেমেন্ট করলে যে ছাড়গুলো পাওয়া যায় অনেক সময় ইএমআই বা নো কস্ট ইএমআই এর ক্ষেত্রে সেই ছাড় গুলো পাওয়া যায় না।
যেমন সেল এর সময় অনলাইনে কেনাকাটায় কার্ডে পেমেন্টের ক্ষেত্রে যে 10% ছাড় পাওয়া যায় সেই ছাড়টা অনেক সময় ইএমআই তে পাওয়া যায় না।
আবার ফ্লিপকার্ট বা অ্যামাজনের ক্রেডিট কার্ডে ওদের নিজস্ব প্লাটফর্মে কেনাকাটার ক্ষেত্রে 5% ক্যাশব্যাক পাওয়া যায়। ইএমআই এর ক্ষেত্রে কিন্তু এই ক্যাশব্যাক টা পাওয়া যায় না।
পরোক্ষভাবে এক্সট্রা খরচ
নো কস্ট ইএমআই তে ব্যাংক বা অন্য যে ফিন্যান্সিয়াল অর্গানাইজেশন লোন প্রোভাইড করছে তারা প্রসেসিং ফি এবং ইন্টারেস্ট পেয়ে যাচ্ছে মানে তাদের লাভই হচ্ছে। সরকার প্রোডাক্টের দামের ওপর এবং লোনের ইন্টারেস্ট এর ওপর যা জিএসটি হওয়ার কথা সেটা পেয়ে যাচ্ছে, মানে তাদেরও লাভ হচ্ছে। ব্র্যান্ড এবং অনলাইন বা অফলাইন দোকানের প্রোডাক্ট বিক্রি হচ্ছে, স্টক ক্লিয়ারেন্স হচ্ছে, ক্যাশ ফ্লো হচ্ছে, মানে তাদেরও লাভ হচ্ছে। আর আপনার বা আমার মত ক্রেতারা ইন্টারেস্ট ছাড়া ইএমআই এর সুবিধা নিয়ে প্রোডাক্ট কিনতে পারছি মানে আমাদেরও লাভ হচ্ছে? সত্যিই কি তাই ? সবারই লাভ? তাহলে আমাদের এই এক্সট্রা ‘সুবিধা’ পাইয়ে দেওয়ার জন্য লস টা কার হচ্ছে? আসলে এক্সট্রা সুবিধার আড়ালে লস বা এক্সট্রা খরচটা কিন্তু আমাদেরই হচ্ছে!
প্রোডাক্টের দামে
ব্র্যান্ড যখন কোনো প্রোডাক্ট বানায় সেই প্রোডাক্টের যা কস্টিং হয় তার থেকে অনেক বেশি মার্জিন রেখে তবে এমআরপি ফিক্স করা হয়। বিভিন্ন মোবাইল বা অন্য ইলেকট্রনিক্সের জিনিস যদি একটু খেয়াল করেন দেখবেন প্রোডাক্ট লঞ্চের সময় যে দাম থাকে সেই দাম যত দিন যায় আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এক সময় দেখা যায় দাম কমতে কমতে লঞ্চের সময়ের দামের থেকে অর্ধেক বা তারও কম হয়ে যায়। সুতরাং লঞ্চের সময় এ ধরনের প্রোডাক্ট কেনা মানে আমরা অনেক বেশি পে করছি। আর বিভিন্ন রকম ছাড়ের মাধ্যমে প্রোডাক্ট কিনতে প্ররোচিত করার জন্য কোম্পানিগুলোর হাতে অনেকটা স্কোপ প্রথম থেকেই রাখা থাকে। তাই এমনিতে যেসব ছাড়গুলো দেখানো হয় সেগুলো আসলে চোখের ধুলো দেওয়ার জন্য। এক্ষেত্রেও নো কস্ট ইএমআই তে আপাতভাবে যে ইন্টারেস্টটা আসলে আমাদের দিতে হচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে সেটা আগে থেকেই প্রোডাক্টের যে দাম নেওয়া হচ্ছে তার সাথেই নিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
দামী প্রোডাক্ট কিনে
সাধারণত ইএমআই তে আমরা প্রোডাক্ট কিনি তখনই যখন একবারে প্রোডাক্ট এর পুরো দাম দেওয়া আমাদের জন্য সম্ভবপর হয়ে ওঠে না, মানে ক্ষমতার বাইরে দামী প্রোডাক্ট কেনার সময়। এই নো কস্ট ইএমআই এর সুবিধা না পেলে হয়তো আমরা সেই দামী প্রোডাক্টটা কিনতাম না এবং তার বদলে কোন সস্তা বিকল্প খুঁজে নিতাম। তাই এই নো কস্ট ইএমআই-এর জন্য দামি প্রোডাক্ট কিনে আমাদের প্রয়োজনের থেকে বেশি খরচ হয়ে যায়।
অপ্রয়োজনীয় প্রোডাক্ট কিনে
অনেক সময় নো কস্ট ইএমআই এর সুবিধা পাওয়া যায় বলে কিছু কিছু প্রোডাক্ট যেগুলো আসলে আমাদের দরকার নেই বা না হলেও চলে, এককালীন বেশি খরচ করতে হচ্ছে না এই ভেবে সেগুলো কিনে এক্সট্রা খরচ করে ফেলি।
সঞ্চয় না করে
দামি প্রোডাক্ট কেনা হোক, প্রয়োজনের আগে কেনা হোক বা অপ্রয়োজনীয় প্রোডাক্ট কেনা হোক, সব ক্ষেত্রেই কিন্তু আমাদের খরচ হতে থাকে। আর নো কস্ট ইএমআইও কিন্তু একটা ইএমআই। এর সুবিধে নেওয়া মানে কেনার সময় হয়তো বেশি খরচ হলো না, কিন্তু সেই খরচের বোঝাটা আগামী অনেক মাসের উপরে চেপে যায়। মানে ইনস্টলমেন্ট গুলো যত মাস চলে তত মাস সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে ঘাটতি পড়ে যায়। যে টাকাটা সঞ্চয় করলে বা শেয়ার বাজারে ইনভেস্ট করলে আরো বড় হতে পারতো সেই টাকাটা ক্রমাগত খরচের খাতায় যেতে থাকে।
বাজে অভ্যাস তৈরি হয়ে
যারা বারে বারে এই নো কস্ট ইএমআই এর সুবিধা নিয়ে কেনাকাটা করেন তাদের এটা একটা বদ অভ্যাসে পরিণত হয়। লোনের বোঝা ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং ব্যক্তিগত ফাইন্যান্সের দিকটা পুরো ঘেঁটে যায়।
ইনস্টলমেন্ট মিস করলে আরও খরচ
ভবিষ্যতের কোনো অনিশ্চয়তা থেকেই হোক বা ক্যাজুয়ালি ভুলে যাওয়া থেকেই হোক যদি কখনো একটা ইনস্টলমেন্ট মিস হয়ে যায় তাহলে কিন্তু আরো বিপদ। পেনাল্টি সহ এক্সট্রা খরচ তো আছেই তার সাথে ক্রেডিট স্কোরের উপর প্রভাব পড়ে যেটা ভবিষ্যতে কোন জেনুইন কারণে লোন এর দরকার পড়লে বাধার কারণ হতে পারে বা লো ক্রেডিট স্কোরের জন্য আপনাকে বেশি ইন্টারেস্ট দিতে হতে পারে।
শেষ করার আগে…
সুতরাং সবশেষে বলতে চাইব, এই নো কস্ট ইএমআই-তে কিছু কেনাকাটা করতে গেলে পুরো বিষয়টা আগে জানা ও বোঝা দরকার। এবং যে সময়ে, যে ওয়েবসাইটে / দোকানে যে কার্ড ব্যবহার করার কথা ভাবা হচ্ছে হিসেব করে দেখে নিতে হবে সেসময়ে বা সেই কার্ডে এই সুবিধা নিতে গিয়ে কতটা বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে। এবং তার পরই এর সুবিধা নেওয়ার ব্যপারে অন্তিম সিদ্ধান্তটা নেওয়া উচিৎ।
আর এই সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানী ও রেসপন্সিবল হতে হবে। ঠিক কারনে ব্যবহার করা হলে খরচ কিছুটা বেশি হলেও নো কস্ট ইএমআই-এর এই সুযোগ বা সুবিধাটা মন্দ না। কিন্তু যদি কারণ, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন সঠিক হয় তবেই। আর এর অপব্যবহার করলে কিন্তু এটা ভালোর থেকে খারাপই বেশি। তাই বুঝে শুনে সবদিক ভেবে তবেই এর ব্যবহার করে কেনাকাটা করতে যাওয়া উচিৎ।
আজ তাহলে এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকবেন। টা টা । 🙂